স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যাপ্ত সেবা দিতে তৈরি নয়

দেশের মাত্র ৪ শতাংশ সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগ শনাক্ত করার পাঁচটি মৌলিক পরীক্ষার সব কটি করা যায়। শিশুর চিকিৎসায় অত্যাবশ্যকীয় ছয়টি ওষুধ থাকে মাত্র এক-তৃতীয়াংশ প্রতিষ্ঠানে। ৭৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠান পরিবার পরিকল্পনা সেবা দিতে প্রস্তুত নয়।

হাসপাতাল, ক্লিনিক ও সেবাকেন্দ্রের এই চিত্র তুলে ধরেছে সরকারের জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট) তাদের ‘বাংলাদেশ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান জরিপ ২০১৭’ প্রতিবেদনে। প্রাথমিক এই প্রতিবেদন নিপোর্ট তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে দুই দিন আগে। এই প্রতিবেদন বলছে, ওষুধ সরবরাহ ও প্রসবপূর্ব সেবার প্রস্তুতিসহ কিছু ক্ষেত্রে ২০১৪ সালের তুলনায় পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে।

এই পরিস্থিতিতে দেশে শিশুমৃত্যু কমছে না। পরিবার পরিকল্পনা সেবার মান খারাপ হওয়ায় জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির ব্যবহার বাড়ছে না, নারীপ্রতি সন্তান জন্মদানের হার কমছে না। এ নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে।

নিপোর্টের জরিপে চিকিৎসক, নার্স, প্রযুক্তিবিদ বা অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর পদ বা তাঁদের উপস্থিতির বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। হাসপাতাল, ক্লিনিক বা সেবাকেন্দ্রের অবকাঠামো পরিস্থিতি, চিকিৎসা সরঞ্জাম, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মেনে সেবা দেওয়া হয় কি না, এসব বিষয়ে দেখা হয়েছে। মাতৃ, নবজাতক ও শিশুস্বাস্থ্যসেবা, পরিবার পরিকল্পনা সেবা ও কিছু অসংক্রামক রোগে (ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ ও যক্ষ্মা) চিকিৎসায় প্রতিষ্ঠানগুলোর তৈরি থাকার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

জরিপের ফলাফল নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি রশীদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, চিকিৎসক থাকলেই মানুষ সেবা পাবে, সবকিছু ঠিকঠাকমতো চলবে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই ধারণা পুরোপুরি ঠিক নয়। একটি অকার্যকর কাঠামোর মধ্য দিয়ে হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, লজিস্টিক সরবরাহ করা হয়। যথাযথ জনবলও দেওয়া হয় না। চাহিদাভিত্তিক সরঞ্জাম, ওষুধ, যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করে ওপর থেকে সবকিছু চাপিয়ে দেওয়া হয়। পাশাপাশি নজরদারিরও ঘাটতি আছে।

তবে জরিপের ফলাফল নিয়ে আপত্তি তুলেছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতাল-ক্লিনিকে এত খারাপ পরিস্থিতি নয়, কখনো ছিল বলে মনে হয় না। পরিস্থিতি এত খারাপ হলে স্বাস্থ্য সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি সম্ভব হতো না।

১ হাজার ৫২৪টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য ২০১৭ সালের ৩০ জুলাই থেকে ১৯ অক্টোবরের মধ্যে সংগ্রহ করা হয়। জরিপের মধ্যে ছিল কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্র, মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র, জেলা হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। পাশাপাশি ২০ বা তার বেশি শয্যার ব্যক্তিমালিকানাধীন বা এনজিও হাসপাতাল ও ক্লিনিকের ওপর জরিপ করা হয়। এ ছাড়া পাঁচ হাজার স্বাস্থ্যকর্মীরও সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। তবে জরিপে বিশেষায়িত হাসপাতাল ও বেসরকারি বড় হাসপাতাল অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।জরিপে অবশ্য কিছু বিষয়ে অগ্রগতি দেখা গেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে পানি, বিদ্যুৎ সরবরাহ বেড়েছে। শৌচাগারও বেড়েছে। রোগীর পরামর্শকালীন গোপনীয়তা বেড়েছে।

>

নিপোর্টের জরিপ। শিশুমৃত্যু কমছে না। জন্মনিয়ন্ত্রণসেবার অবস্থা ভালো নয়। সেবা প্রতিষ্ঠানে পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে।

নিপোর্টকে এই জরিপে কারিগরি সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আইসিএফ নামের প্রতিষ্ঠান। মাঠের কাজ ও উপাত্ত সংগ্রহে নজরদারি করেছে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)। এই জরিপে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের দাতা সংস্থা ইউএসএআইডি। এর আগে ২০০৯, ২০১১ ও ২০১৪ সালে এই জরিপ হয়েছিল। জরিপ প্রতিবেদনে বলা আছে, ২০১৮ সালের শেষ দিকে প্রতিবেদন প্রকাশের কথা ছিল। কিন্তু কেন এক বছর পর প্রকাশ করা হলো, তা বলা নেই।

অবকাঠামো ও ব্যবস্থাপনা

জরিপ প্রতিবেদন বলছে, প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই নারীদের প্রসবপূর্ব ও প্রসব-পরবর্তী সেবা, অসুস্থ শিশুর চিকিৎসা, কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যসেবা এবং পুষ্টিসেবা দেওয়ার কথা বলে। কিন্তু মানসম্পন্ন সেবা দেওয়ার জন্য যে ছয় ধরনের মৌলিক সরঞ্জামের দরকার, তার সব কটি আছে মাত্র ২৮ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে। সরঞ্জামগুলো হচ্ছে স্টেথোস্কোপ, থার্মোমিটার, রক্তচাপ পরিমাপ যন্ত্র, বয়স্কদের উচ্চতা পরিমাপ স্কেল, শিশুদের স্কেল ও আলোর উৎস। ৭২ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে কোনো না কোনো সরঞ্জামের ঘাটতি আছে।

হিমোগ্লোবিন, রক্তের শর্করা, প্রস্রাবে শর্করা, প্রস্রাবে প্রোটিন ও প্রস্রাবের মাধ্যমে গর্ভ পরীক্ষা—প্রতিবেদনে এই পরীক্ষাকে রোগ শনাক্তের মৌলিক পরীক্ষা বলা হয়েছে। মাত্র ৪ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে সব কটি পরীক্ষা হয় বলে জরিপে জানা গেছে। বাকি ৯৬ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে একটি বা একাধিক পরীক্ষার ঘাটতি আছে।

নবজাতক ও শিশু সেবা

সরকার বলছে, তারা স্বাভাবিক প্রসবে সন্তান জন্মের হার বাড়াতে চায়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগে ঘাটতি আছে বলে জরিপে উঠে এসেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, স্বাভাবিক প্রসব নিরাপদ করার জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ১৩টি বিষয় থাকা প্রয়োজন। এগুলো হলো জরুরি প্রসূতিসেবা নির্দেশিকা, যেকোনো সময় প্রসবসেবা দেওয়ার প্রশিক্ষিত কর্মী, পরীক্ষার জন্য পর্যাপ্ত আলো, প্রসবের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির প্যাকেট, শোষণযন্ত্র, নবজাতকের প্রয়োজনীয় উপকরণ ও মাস্ক, পার্টোগ্রাফ, দস্তানা, ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া অক্সিটসিন, ইনজেকশনের মাধ্যমে দেওয়া অ্যান্টিবায়োটিক, ম্যাগনেশিয়াম সালফেট, ত্বকের সংক্রমণনিরোধক এবং শিরায় তরল দেওয়ার উপকরণ। এই তালিকা ধরে জরিপকারীরা দেখেছেন, মাত্র ১ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে ১৩টি বিষয় আছে। প্রসূতি ও নবজাতকের জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ও সরঞ্জাম থাকে না অনেক প্রতিষ্ঠানে।

শিশুদের চিকিৎসায় ছয়টি ওষুধ অত্যাবশ্যক বলে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে খাওয়ার স্যালাইন, অ্যামোক্সসিলিন সিরাপ, প্যারাসিটামল সিরাপ, ভিটামিন এ ক্যাপসুল, অ্যালবেনডাজোল/মেবেনডাজোল ও জিঙ্ক ট্যাবলেট। মাত্র ৩৩ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে এই ৬ ওষুধ সার্বক্ষণিক সরবরাহ দেখেছেন জরিপকারীরা। ২০১৪ সালের জরিপে এই হার ৪২ শতাংশ ছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শিশুর রোগ নিরাময় সেবা পরিস্থিতি ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে উন্নতি হয়নি।

পরিবার পরিকল্পনা ও প্রসবপূর্ব সেবা

একটি প্রতিষ্ঠান পরিবার পরিকল্পনা সেবা দিতে কতটুকু প্রস্তুত, তা নির্ভর করে কয়েকটি বিষয়ের প্রাপ্যতার ওপর। এগুলো হচ্ছে পরিবার পরিকল্পনা নির্দেশিকা, কমপক্ষে একজন প্রশিক্ষিত কর্মী, রক্তচাপ মাপার যন্ত্র, তিনটি জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি—খাওয়ার বড়ি, কনডম ও ইনজেকশন। জরিপের সময় ২২ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে এই প্রস্তুতি দেখা গিয়েছিল।

প্রায় সব ধনের প্রতিষ্ঠান গর্ভবতী নারীদের প্রসবপূর্ব সেবা দেয়। তবে অনেক প্রতিষ্ঠানে সেবাদানের নির্দেশিকা নেই। ১০ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে প্রসবপূর্ব সেবার জন্য অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের ঘাটতি আছে। ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে সেবার প্রস্তুতি কিছুটা বাড়লেও সার্বিকভাবে ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৭ সালে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।

প্রতিবেদনের শুরুতে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে সেবা প্রাপ্যতা ও নির্দিষ্ট সেবার ক্ষেত্রে প্রস্তুতি মূল্যায়ন করা ছিল জরিপের অন্যতম উদ্দেশ্য। তবে জরিপ ফলাফলে দেখা গেছে, অতীতের চেয়ে জরুরি রোগী পরিবহনসেবা, শিশুর উপশমসেবা পরিস্থিতিসহ কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি হয়নি।