মা-বাবার প্রতীক্ষায় ওরা

এদের বয়স চার থেকে সাত বছরের মধ্যে। মা–বাবাকে হারিয়ে বড় হচ্ছে ছোটমণি নিবাসে। স্বজনের স্নেহবঞ্চিত এই শিশুগুলো ফিরে যেতে চায় মা–বাবার কাছে। গত ২১ নভেম্বর নগরের রৌফবাদে ছোটমণি নিবাস থেকে তোলা।  গাজী ফিরোজ
এদের বয়স চার থেকে সাত বছরের মধ্যে। মা–বাবাকে হারিয়ে বড় হচ্ছে ছোটমণি নিবাসে। স্বজনের স্নেহবঞ্চিত এই শিশুগুলো ফিরে যেতে চায় মা–বাবার কাছে। গত ২১ নভেম্বর নগরের রৌফবাদে ছোটমণি নিবাস থেকে তোলা। গাজী ফিরোজ

মায়ের স্নেহ, বাবার আদর কী তা বুঝতে পারে না তাসফিয়া আক্তার। এরপরও ‘মা’ ও ‘বাবাকে’ ডাকে সে। কিন্তু তার ডাকে সাড়ে মেলে না। মা-বাবা ছাড়াই এক বছর ধরে চট্টগ্রামের রৌফাবাদের ছোটমণি নিবাসে থাকতে হচ্ছে তাকে। কী তার ঠিকানা। কে তার মা-বাবা জানে না তাসফিয়া। ২০১৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে চার বছর বয়সে পুলিশ তাকে উদ্ধার করে। এটুকু বয়সেই কী ভয়াবহ ঘটনারই না শিকার হয়েছে সে! সেই থেকে তার ঠিকানা হয় সরকারি ছোটমণি নিবাস।

হারিয়ে যাওয়ার ভয়াবহতা বোঝার বয়স হয়নি পাঁচ বছরের বছরের মৌ আক্তারেরও। তবে এটুকু বুঝতে পারছে, পরিবার থেকে সে অনেক দূরে। সবসময় হাসিখুশি থাকলেও তার চোখে যেন পরিবার ফিরে পাওয়ার আকুলতা।

শুধু ওই দুই শিশু নয়, চট্টগ্রামের রৌফাবাদে অবস্থিত ছোটমণি নিবাসে ৩৪ শিশু রয়েছে। শূন্য থেকে সাত বছর বয়সী শিশুরা রয়েছে এখানে। কেউ জানে না কারা তাদের মা-বাবা। কী তাদের ঠিকানা। সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন সরকারি ছোটমণি নিবাসে তারা বেড়ে উঠলেও ফিরে যেতে চায় মায়ের কোলে।

ছোটমণি নিবাসের উপতত্ত্বাবধায়ক নুরুন নাহার জান্নাতী তাঁর কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘৩৪ শিশুর মধে৵ ১৪ জন হারিয়ে যাওয়া শিশু। বাকিদের কাউকে হাসপাতালে কিংবা রাস্তায় ফেলে যাওয়া হয়। এদের মধে৵ প্রতিবন্ধী রয়েছে ১৫ জন। সবাই ভালো আছে।

হারিয়ে যাওয়া এসব শিশুর প্রকৃত অভিভাবক খুঁজে বের করা আমাদের মানবিক দায়িত্ব। শিশুর জন্য পরিবারের বিকল্প না থাকায় তাদের প্রকৃত অভিভাবকের নিকট ফিরিয়ে দেওয়াই আমাদের প্রধান লক্ষ্য। হারিয়ে যাওয়া শিশুদের প্রকৃত অভিভাবককে আদালতের মাধ্যমে হস্তান্তর করা হবে। সন্তানহারা মা-বাবা ফিরে পাবে বুকের ধনকে। শিশু পাবে তার পরিবারকে।’

গত ২১ নভেম্বর ছোটমণি নিবাসে গিয়ে কথা হয় শিশু মো. সাইফের সঙ্গে। ২৪ জুন নগরের অক্সিজেন এলাকায় সে হারিয়ে যায়। বাসার ঠিকানা সে বলতে পারে না। সে শুধু বলে মা-বাবার কাছে যাবে। সাত বছর বয়সী আরেক শিশু মো. সাগর, পাঁচ বছর বয়সী মো. মিনহাজ, নুরুল আবছার, মো. রাজু, মো. আসিফ সবার একই কথা মা-বাবার কাছে ফিরে যাবে।

ছোটমণি নিবাসে এসব শিশুদের পড়াশোনার জন্য রয়েছেন সহকারী শিক্ষক বন্দনা সরকার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। হারিয়ে যাওয়া শিশুরাও রয়েছে। তারা ছোটমণি নিবাসে আছে। অনেকের মা-বাবা হয়তো জানেন না। পরিবারের কাছে ফিরে গেলে তাদের সুন্দর ভবিষ্যৎ হবে।

দুই মাস বয়সী এক কন্যা শিশুর হাসপাতাল থেকে ঠিকানা হয় ছোটমণি নিবাস। চলতি বছরের ২০ আগস্ট ভোর পাঁচটার দিকে নগরের ডবলমুরিং থানার আগ্রাবাদ সোনালী ব্যাংকের সামনের ফুটপাতে পড়ে ছিলেন মানসিক ভারসাম্যহীন এক নারী ও তাঁর সদ্যোজাত কন্যাশিশুটি।

ওই সময় থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মোস্তাফিজুর রহমান মা ও শিশুটিকে হাসপাতালে নিয়ে যান। শিশুটিকে লালনপালনের জন্য গত ২১ অক্টোবর আদালতে আবেদন করেন নগরের চান্দগাঁওয়ের বাসিন্দা আবদুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী কামরুন নাহার। তাঁরা নিজেদের নিঃসন্তান দম্পতি দাবি করেছেন। ২৯ অক্টোবর আদালত লালনপালনের জন্য শিশুটিকে ওই দম্পতিকে দিতে নির্দেশ দেন।

জন্মের ৭০ দিন পর গত ৩০ অক্টোবর শিশুটি ওই দম্পতির কোলে দেওয়া যায়। বর্তমানে সে ভালো আছে। ওই দম্পতি প্রথম আলোকে জানিয়েছেন শিশুটিকে তাঁরা নিজেদের পরিচয়ে মানুষের মতো মানুষ করবেন।

১৯৮৪ সালে চালু হওয়া ছোটমণি নিবাসে এ পর্যন্ত ৩৯০ জন শিশু ছিল। ৪১ শিশুকে অভিভাবকের কাছে এবং ৮ জনকে আদালতের নির্দেশে লালনপালনের জিম্মায় দেওয়া হয়েছে। বাকিদের পুনর্বাসন করা হয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন সমাজসেবা অধিদপ্তরের ছোটমণি নিবাসে পরিত্যক্ত, ঠিকানাহীন, বিপন্ন ও দুর্দশাগ্রস্ত শূন্য থেকে সাত বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের রক্ষণাবেক্ষণ, ভরণপোষণ, চিকিৎসা, বিনোদন , শিক্ষা ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা হয়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছোটমণি নিবাস ও শিশু পরিবারগুলোতে থাকার চাইতে শিশুরা আরও ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারত, যদি তারা থাকত পারিবারিক আবহে। কিন্তু সারা বিশ্বে দত্তক নেয়ার যে জনপ্রিয় ব্যবস্থা সেই ব্যবস্থাটি বাংলাদেশের আইনে নেই।

অবশ্য পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন আগ্রহী নিঃসন্তান দম্পতি জানিয়েছেন, পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে শিশুর অভিভাবকত্ব নেওয়া গেলেও অনেক জটিলতার স্বীকার হতে হয় বলেও এ পথে তাঁরা যেতে চান না​।