পরিত্যক্ত প্লাস্টিকে ভাগ্য বদল

বাঘাইছড়ির গাড়িচালক মো. শফিকুল ইসলাম পরিত্যক্ত প্লাস্টিক দিয়ে তেল তৈরি করছেন।  সংগৃহীত
বাঘাইছড়ির গাড়িচালক মো. শফিকুল ইসলাম পরিত্যক্ত প্লাস্টিক দিয়ে তেল তৈরি করছেন। সংগৃহীত

জামালপুরের তৌহিদুল ইসলামের পর রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলা সদরের মো. শফিকুল ইসলামও (২৫) নিজ চেষ্টায় প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য থেকে জ্বালানি তেল উদ্ভাবন করেছেন। এই কাজ করে এলাকায় তিনি রীতিমতো সাড়াও ফেলে দিয়েছেন। প্লাস্টিক থেকে পাওয়া তেল বিক্রি করে এখন তাঁর সংসার বেশ ভালোই চলছে।

বাঘাইছড়ির শফিকুল পেশায় জিপচালক। একবার প্লাস্টিকের বোতল গলিয়ে গাড়ির পাইপের ফুটো মেরামত করতে গিয়ে দেখলেন, গলানো বোতল থেকে তেলজাতীয় রাসায়নিক তৈরি হচ্ছে। এরপর এ নিয়ে নতুন কিছু করার ভাবনা তাঁকে পেয়ে বসে। নিজের উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে পরিত্যক্ত প্লাস্টিক গলিয়ে পেট্রলসহ চার ধরনের জ্বালানি তেল তৈরি করতে সক্ষম হলেন তিনি। এখন বাঘাইছড়ি সদরের মাস্টারপাড়ায় নিজ বাড়িতে বসেই প্লাস্টিক থেকে তৈরি করছেন জ্বালানি তেল। এই তেল দিয়ে দিব্যি যানবাহনও চলছে। আর শফিকুল এই কাজ করে দৈনিক আয় করছেন দুই হাজার টাকার মতো। রাতারাতি অবস্থাও বদলে গেছে তাঁর। সংসারেও এসেছে সচ্ছলতা।

 শফিকুলের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত তিন মাস তেল উৎপাদন করে বিক্রি করছেন তিনি। বাঘাইছড়ি পৌরসভার মাস্টারপাড়ায় তাঁর বাড়ি। তাঁর বাড়ির উঠানে চুলা বসিয়ে তেল তৈরি করেন তিনি। সেখানে তেল কিনতে ভিড় করেন মোটরসাইকেল ও জিপচালকেরা। তাঁর উৎপাদিত তেল এমনকি পাম্প মেশিনেও ব্যবহার করা হচ্ছে।

কীভাবে শুরু, জানতে চাইলে শফিকুল ইসলাম বলেন, গত আগস্ট মাসের শেষের দিকে তাঁর ট্রাক্টরের একটি পাইপ ফেটে যায়। সেই পাইপ জোড়া লাগানোর জন্য প্লাস্টিকের বোতল আগুনে গলিয়ে নেন। তখন দেখতে পান, পোড়া প্লাস্টিক থেকে তেলের মতো এক ধরনের রাসায়নিক বের হচ্ছে। তখন থেকে তাঁর মনে সন্দেহ হয় প্লাস্টিক থেকে কিছু একটা পাওয়া যাবে। পরে সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে পরিত্যক্ত প্লাস্টিক সংগ্রহ করেন। পরে একটি ড্রামে প্লাস্টিক রেখে চুলায় সেগুলো পোড়ান। ড্রাম থেকে প্লাস্টিকের ধোঁয়া পাইপের মাধ্যমে আরেকটি বোতলে তেল হিসেবে জমা হয়। ওই তেল দিয়ে মোটরসাইকেল, পানির পাম্প মেশিন, ট্রাক্টর, জিপ গাড়ি দিব্যি চলছে।

শফিকুল আরও জানান, প্রতিদিন তিনি ৩০ থেকে ৩৫ লিটার তেল তৈরি করেন। এর মধ্যে ডিজেল ১৫ লিটার, অকটেন ৭ লিটার, পেট্রল ৫ লিটার আর সাদা কেরোসিন ৭ লিটারের মতো পাচ্ছেন। উৎপাদিত ডিজেল আর কেরোসিন ৫৫ টাকা, অকটেন ৭৫ টাকা ও পেট্রল ৭০ টাকা করে বিক্রি করছেন। পরিত্যক্ত প্লাস্টিক থেকে তেল তৈরি করে দৈনিক আয় হচ্ছে দুই হাজার টাকারও বেশি। ড্রাম, পাইপ, চুলা ও লাকড়ি সংগ্রহ করতে তাঁর অন্তত ৫০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিদিন পরিত্যাক্ত প্লাস্টিকের বোতল সংগ্রহ করতে অল্প কিছু টাকা খরচ হয় তাঁর।

বিভিন্ন বিজ্ঞান সাময়িকী ঘেঁটে দেখা গেছে, পরিত্যক্ত প্লাস্টিক থেকে জ্বালানি তেল তৈরি বিজ্ঞানসম্মত বিষয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমনটা হচ্ছেও। প্লাস্টিক জ্বালানি তেলেরই একটি উপজাত। সেটিকে সহজেই গলিয়ে আবার পেট্রল ও ডিজেলে পরিণত করা সম্ভব। তবে প্রযুক্তিগত জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও শফিকুল নিজের ভাবনা থেকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে জ্বালানি তেল তৈরি করেছেন। শফিকুলের আগে জামালপুর জেলার তৌহিদুল ইসলাম পরিত্যক্ত পলিথিন ও প্লাস্টিক থেকে জ্বালানি তেল তৈরি করেছেন। এই কাজ করে তৌহিদুল পরিবেশবিষয়ক গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবন বিভাগের জাতীয় পরিবেশ পদকও পেয়েছেন।

স্থানীয় মো. এমতাজ আলী বলেন, পরিত্যক্ত প্লাস্টিক থেকে তেল তৈরি করে শফিকুল এলাকা তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকা থেকে তাঁর তেল তৈরির কারখানা দেখতে আসছেন। ডিজেল, অকটেন ও পেট্রল তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চালকেরা কিনে নিয়ে যাচ্ছে।

গাড়িচালক মো. সুন্দর আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘শফিকুলের তৈরি করা তেল দিয়ে আমরা গাড়ি ও মোটরসাইকেল চালাচ্ছি। প্রায় এক মাস ধরে তাঁর তেল ব্যবহার করে আসছি। এ পর্যন্ত গাড়ি চালাতে কোনো সমস্যা হয়নি।’

বাঘাইছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আহসান হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘শফিকুলের প্লাস্টিক দিয়ে তেল তৈরির কারখানাটি সরেজমিনে দেখেছি। পরিত্যক্ত প্লাস্টিক পুড়িয়ে ডিজেল, অকটেন ও পেট্রল তৈরি হচ্ছে। তবে প্লাস্টিক পোড়ানোর সময় কটু গন্ধ বের হয়। সেটা কীভাবে দূর করা যায়, এ নিয়ে ভাবতে হবে।’