ঢাকার দুই সিটিতে ওষুধ ছিটানোয় গতি নেই, মশার কামড়ে অতিষ্ঠ

কচুরিপানা ও আবর্জনার স্তূপে বাড়ছে মশার বিস্তার। সম্প্রতি ঢাকার বাড্ডার আনন্দনগর ঝিলপাড়ে। ছবি: প্রথম আলো
কচুরিপানা ও আবর্জনার স্তূপে বাড়ছে মশার বিস্তার। সম্প্রতি ঢাকার বাড্ডার আনন্দনগর ঝিলপাড়ে। ছবি: প্রথম আলো

শীত আসার আগেই মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন ঢাকার দুই সিটির বাসিন্দারা। এডিসের আতঙ্ক কাটতে না কাটতেই কিউলেক্স মশার উপদ্রব বেড়েছে রাজধানীতে। মশা মারার ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রমে ভাটা পড়ায় মশা বেড়ে গেছে বলে অভিযোগ নগরবাসীর।

জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক কবিরুল বাসার প্রথম আলোকে বলেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে সিটি করপোরেশন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাদের যা শক্তি ছিল তা খরচ করে ফেলেছে। তবে কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে প্রজননক্ষেত্র শনাক্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ, কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ফগিং করার চেয়ে লার্ভা ধ্বংস করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, এডিসের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাও থামানো উচিত নয়। কারণ, এখনো প্রতিদিন অনেক রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে মশকনিধন কর্মী আছেন ছয়জন। এর মধ্যে গত রোববার বিকেলে ওষুধ ছিটিয়েছেন তিনজন। বাকি তিনজনের মধ্যে দুজন ফগার মেশিন চালাতে পারেন না। আরেকজন ওয়ার্ড ইনচার্জের দায়িত্বে থাকার কারণে তিনি কখনোই ওষুধ ছিটানোর কাজে যান না। ওয়ার্ডের মশকনিধন কর্মীরা হলেন আবদুস সালাম, নজরুল ইসলাম, লোকমান হোসেন, নাহিদুল, সদরুল হোসেন ও শুক্কুর আলম।

গত রোববার বিকেল পৌনে পাঁচটায় ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে নাহিদুলের অবস্থান জানার জন্য তাঁর মুঠোফোনে কল করা হলে তিনি দোকানে আছেন বলে জানান। মশার ওষুধ কখন ছিটাবেন এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, কিছুক্ষণ পর ছিটাবেন। তবে আরেক কর্মী আবদুস সালাম বলছেন, নাহিদুল ফগার মেশিন চালাতে পারেন না। তিনি শুধু সকালেই ওষুধ ছিটান।

>

উত্তর সিটির বাসিন্দারা বলছেন, ডেঙ্গুর সময় যে তোড়জোড় ছিল, এখন তাতে ভাটা পড়েছে। আর দক্ষিণে ওষুধই ছিটানো হয় কম।

পরে ওয়ার্ডের ইনচার্জ সদরুল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, পল্টন কমিউনিটি সেন্টারে তিনি আছেন। কোথায় ওষুধ ছিটিয়েছেন এ বিষয়ে কিছু বলেননি। পরে অন্য মশকনিধন কর্মীরা জানান, সদরুল ওয়ার্ডের ইনচার্জ। তাই তিনি মশার ওষুধ ছিটান না। আর ওই দিন বিকেল ৪টা ৪০ মিনিটে লোকমান হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, কাজ শেষ করে ফিরেছেন তিনি। রেলওয়ে কলোনিতে তিনি মশার ওষুধ ছিটিয়েছেন বলে দাবি করেন।

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন ওয়ার্ডে নিয়মিত মশার ওষুধ না ছিটানোর অভিযোগ দীর্ঘদিনের। শাহজাহানপুরের বাসিন্দা আকবর হোসেন বলছেন, দিন–রাত ২৪ ঘণ্টা মশার যন্ত্রণায় তাঁর পরিবারের সদস্যরা অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। করপোরেশন নিয়মিত মশার ওষুধ না ছিটিয়ে মাঝে মাঝে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম করছে। এভাবে মশক নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।

ডিএসসিসির স্বাস্থ্য বিভাগের ভাষ্য, ৫৭টি ওয়ার্ডে তাদের ৪৩৮ জন মশকনিধন কর্মী আছেন। এর মধ্যে স্থায়ী ২৭১ ও অস্থায়ী ১৪৮ জন। সুপারভাইজার আছেন ১৯ জন। দক্ষিণ সিটিতে বর্তমানে ফগার মেশিন আছে ৫৫৯টি, আর স্প্রে মেশিন আছে ৫৫২টি।

নিয়মিত মশার ওষুধ ছিটানোর কার্যক্রম সরেজমিনে দেখতে গত রোববার ডিএসসিসির ২০ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা ঘুরেও মশকনিধন কর্মীদের দেখা যায়নি।

সেগুনবাগিচা এলাকার বাসিন্দা আফসানা হক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, করপোরেশনের হেঁয়ালিপনার কারণে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। এরপরও তাদের হুঁশ না হওয়াটা দুঃখজনক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কাউন্সিলর প্রথম আলোকে বলেছেন, মশকনিধন কর্মীরা সকালে ওষুধ ছিটান না। কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে হলে সকালের ওষুধ ছিটানো জরুরি।

জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরীফ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, গত শনিবার থেকে তাঁরা ক্র্যাশ প্রোগ্রাম শুরু করেছেন। প্রথম পর্যায়ে সপ্তাহব্যাপী এই কার্যক্রম চলবে।

উত্তরেও মশকনিধনে ভাটা

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে জানা গেছে, মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ডিএনসিসির ৫৪টি ওয়ার্ডে স্থায়ী ২৭০ জন কর্মী আছেন। এ ছাড়া আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ২০০-এর বেশি জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আর ডিএনসিসিতে ২৩৮টি ফগার, ২০টি মিস্ট ব্লোয়ার মেশিন নতুন কেনা হয়েছে।

গত রোববার ডিএনসিসির ১৮, ২১ ও ২২ নম্বর ওয়ার্ডে সরেজমিনে দেখা যায়, সেসব এলাকার মানুষ মশকনিধন কার্যক্রমের কোনো সুফল পাচ্ছেন না।

১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কালাচাঁদপুরের বাসিন্দা সুজান ডি কস্টা বলেন, ‘ডেঙ্গুর সময় কয়েক দিন বেশ তোড়জোড় করে মশকনিধন কার্যক্রম দেখেছি। এখন আর কিছুই নেই। সব ঢিলেঢালাভাবে চলছে। মশার কামড়ে কোথাও স্থির থাকা যায় না। রাতের বেলা মশারির নিচে না বসলে কাজ করতে পারি না।’

বারিধারা, কালাচাঁদপুর, নর্দ্দা, নতুনবাজার, শাহজাদপুর মিলে ১৮ নম্বর ওয়ার্ড। এখানে কালাচাঁদপুর ও শাহজাদপুরে কচুরিপানা আছে। সেগুলো পরিষ্কার হয়নি।

ডিএনসিসির ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জাকির হোসেন (বাবুল) বলেন, ‘এলাকায় এখন মশা একটু বেশি। আমরা চেষ্টা করছি মশা মারার। তবে সব ওয়ার্ডে মশা সমান না।’ দু-এক দিনের মধ্যে তিনি মশা মারার অভিযান শুরু করবেন বলে জানান। তিনি আরও জানান, এই ওয়ার্ডে পাঁচজন স্প্রেম্যান আছেন। আর আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে আরও ১০ জন কাজ করছেন।

১১ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর দেওয়ান আবদুল মান্নান ডিএনসিসির মশকনিধন স্থায়ী কমিটির সভাপতি। তিনি নিজ ওয়ার্ডে মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে কাজ করছেন। তিনি জানান, কিছুদিন মশার ওষুধ দেওয়া হয়নি। সেই সুযোগে মশা বাড়তে পারে।

বাড্ডার আদর্শ নগরের বাসিন্দা ও দোকানি হারুনুর রশীদ বলেন, ‘সকাল থেকেই আমি দোকানে থাকি। এই এলাকায় কোনো মশার ওষুধ ছিটাতে দেখিনি। আর বিকেলেও আগে মাঝে মাঝে ধোঁয়া দিয়ে শব্দ করে ওষুধ দিয়েছে দু-একবার।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএনসিসির একটি ওয়ার্ডের পরিচ্ছন্নতা পরিদর্শক বলেন, কিউলেক্স মশা নিধনে বিশেষ কর্মসূচির আওতায় তাঁরা সকাল সাড়ে আটটা থেকে বেলা একটা পর্যন্ত লার্ভিসাইডিংয়ের কাজ করেন। সব ওয়ার্ডে অন্তত ১০ জন করে স্প্রেম্যান দেওয়া হলে কার্যকরভাবে মশার ওষুধ দেওয়া যেত।

ডিএনসিসির মশকনিধন কার্যক্রম নিয়ে স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এমদাদুল হক বলেন, মশকনিধনে ডিএনসিসি কাজ করছে। একটি কর্মসূচি চলছে। আগে থেকে বিশেষ কর্মসূচি পালন করার কারণে এ বছর আগের বছরের চেয়ে কিউলেক্স মশা কম বলে মন্তব্য করেন তিনি।