মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ার: অবৈধ ২২ দখলদারকে উচ্ছেদ

রাজধানীর কলেজ গেট এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা  টাওয়ার-১–এ উচ্ছেদ অভিযান শেষে সিলগালা  করা আটতলার একটি ফ্ল্যাট। গত মঙ্গলবার  দুপুরে।  ছবি: প্রথম আলো
রাজধানীর কলেজ গেট এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ার-১–এ উচ্ছেদ অভিযান শেষে সিলগালা করা আটতলার একটি ফ্ল্যাট। গত মঙ্গলবার দুপুরে। ছবি: প্রথম আলো

যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্মাণ করা মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারের ফ্ল্যাট বরাদ্দ নিয়ে জালিয়াতির সত্যতা পাওয়ার পর ওই ভবন থেকে ২২ জনকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। অবৈধভাবে সাড়ে ছয় বছর ফ্ল্যাটগুলো দখলে রেখেছিলেন তাঁরা। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও তাঁরা এসব ফ্ল্যাটে বসবাস করছিলেন বলে অভিযোগ ছিল।

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তদন্তে এসব অনিয়ম উঠে আসার পরই গত দুই মাসে এই ২২ জনকে ভবন থেকে উচ্ছেদ করা হলো। এঁদের মধ্যে ১২ জনকে একটি করে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা একটি করে বাড়তি ফ্ল্যাট দখলে রেখেছিলেন। দখলে রাখা অতিরিক্ত ফ্ল্যাটটি তাঁদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। বাকি ১০ জনকে মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ার থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে বলে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট সূত্রে জানা গেছে। উদ্ধার করা সবকটি ফ্ল্যাট সিলগালা করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পরপরই মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারের ৮৪টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ৩৩টি বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু ৩৩টি ফ্ল্যাটের ২৪টি দখল করে নেন ১২ জন মুক্তিযোদ্ধা। এঁদের অনেকেই অনুমতি না নিয়ে টাওয়ারে জোর করে উঠে যান। কেউ কেউ মাঝের দেয়াল ভেঙে দুটি ফ্ল্যাট এক করে জবরদখল করে নেন।

এদিকে কল্যাণ ট্রাস্টের কর্মকর্তারা বলছেন, এই ভবনে আরও অনেকে রয়েছেন, যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা নন। তাঁদের বিরুদ্ধেও তদন্ত হচ্ছে। ফ্ল্যাট দখলে রাখা সাতজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা কি না, সে বিষয়ে গত মঙ্গলবার কল্যাণ ট্রাস্টের কার্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী নিজেই শুনানি করেছেন। এর মধ্যে ছয়জনের বিষয়ে অধিকতর তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারে বসবাস করেও একাধিক সরকারি বাড়ি, জমি পেয়েছেন, তাঁদের ফ্ল্যাট বাতিল করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারের ফ্ল্যাট ও দোকান অবৈধভাবে দখলের বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রথম আলোকে বলেন, ওই ভবনে আরও অমুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। তদন্ত করে যাঁরা অবৈধভাবে ফ্ল্যাট দখল করে রেখেছিলেন, তাঁদেরই উচ্ছেদ করা হয়েছে। এঁদের উচ্ছেদ করতে খুব বেগ পোহাতে হয়েছে। এসব ফ্ল্যাট জোর করে তাঁরা দখলে নিয়েছিলেন বলে জানান মন্ত্রী। এ ছাড়া অনেকের বিরুদ্ধে অধিকতর তদন্ত হচ্ছে। যাঁরা অনিয়ম করেছেন, তাঁদের শাস্তি পেতে হবে বলে জানান তিনি।

>

ফ্ল্যাট জালিয়াতির সত্যতা পাওয়া গেছে
যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নন এমন অনেকে ফ্ল্যাটগুলো দখল করে রেখেছিলেন

ঢাকার মোহাম্মদপুরে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্মিত ভবন এই ‘মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ার-১’। মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারের ফ্ল্যাট ও দোকান শুধু যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারাই যাতে বরাদ্দ পান, সে জন্য এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ভবনটিতে ৮৪টি ফ্ল্যাটের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৬৬টি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। কল্যাণ ট্রাস্টের তদন্ত বলছে, টাওয়ারের ফ্ল্যাট ও দোকান মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট যাঁদের বরাদ্দ দিয়েছে, তাঁদের বেশির ভাগই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা নন। অনেকে আছেন অমুক্তিযোদ্ধা।

অবৈধভাবে ফ্ল্যাট দখলে রেখেছিলেন কেয়াম উদ্দিন মোল্লা। তিনি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবার পুনর্বাসন বহুমুখী সমবায় সমিতির সভাপতি। তাঁকে একটি ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি দুটি দখলে রেখেছিলেন। তাঁর দাবি, ফ্ল্যাটগুলো অনেক ছোট। তাই একটির বদলে দুটি নিয়েছিলেন তিনি। তাঁর কাছ থেকে একটি ফ্ল্যাট উদ্ধার করা হয়েছে।

একই অভিযোগ রয়েছে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা পরিবার পুনর্বাসন বহুমুখী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক বগুড়ার আবু শহীদ বিল্লাহ এবং ঢাকার দোহারের গোলাম মোস্তফা, সাভারের বছিরন নেছার বিরুদ্ধে। তাঁরা সবাই একই কথা বললেন। তাঁদের ভাষ্য, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তাঁদের ১ হাজার ১২২ বর্গফুটের ফ্ল্যাট দেওয়ার কথা। কিন্তু তাঁদের ৮৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাট দিয়েছে। তাই তাঁরা অবশিষ্ট অংশ বুঝে পেতে আরেকটি ফ্ল্যাট দখলে রেখেছিলেন। এই তিনজনের কাছ থেকেও একটি করে ফ্ল্যাট উদ্ধার করে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট।

এ ছাড়া সুনামগঞ্জের সিরাজুল ইসলাম দুটি ফ্ল্যাট দখলে রেখেছিলেন। তাঁর নামে আজিমপুরে সরকারি বাড়ি আছে। সিরাজুল ইসলামের কাছ থেকে একটি ফ্ল্যাট উদ্ধার করা হয়েছে। যশোরের আবদুল লতিফকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ঝিলমিল আবাসিক প্রকল্পে পাঁচ কাঠার প্লট দিয়েছে। আমির হোসেন মোল্লারও মিরপুরের দুয়ারীপাড়ায় নিজস্ব একটি বাড়ি আছে। লতিফ ও আমীর দুজনই মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারে একটি করে ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছিলেন। অথচ সরকারি বাড়ি বরাদ্দ থাকলে কিংবা নিজের কোনো বাড়ি থাকলে মুক্তিযোদ্ধা টাওয়ারে ফ্ল্যাট পাওয়ার কথা নয়। এ কারণে তাঁদের দুজনের নামে বরাদ্দকৃত ফ্ল্যাট বাতিল করা হয়েছে। আবদুল লতিফের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইফতেখারুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, এখনো অনেক অমুক্তিযোদ্ধার দখলে এসব ফ্ল্যাট রয়েছে। আসলে এসব ফ্ল্যাট দেওয়াই হয়েছিল জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে। যে যেভাবে পেরেছেন, সেভাবে দখল করেছেন। তিনি আরও বলেন, ‘অবৈধদের বের করতে আমরা দুই বছর ধরে চেষ্টা করেছি। সর্বশেষ ২২টি ফ্ল্যাট থেকে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করতে পেরেছি।’