গাবতলী থেকে মিরপুর ধুলার রাজ্য

ধুলায় ছেয়ে গেছে পুরো এলাকা। এর মধ্যেই পথ চলতে হচ্ছে নগরবাসীকে। গতকাল বিকেলে রাজধানীর পোস্তগোলা এলাকায়।  ছবি: হাসান রাজা
ধুলায় ছেয়ে গেছে পুরো এলাকা। এর মধ্যেই পথ চলতে হচ্ছে নগরবাসীকে। গতকাল বিকেলে রাজধানীর পোস্তগোলা এলাকায়। ছবি: হাসান রাজা

রাজধানীর গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের দিকে এগোতেই ধুলার রাজ্য যেন গ্রাস করল। সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি নেই, কোনো নির্মাণযজ্ঞও চোখে পড়ল না। তাহলে এত ধুলা এল কোত্থেকে! এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে খানিক দূর এগোতে হলো। বেড়িবাঁধ ধরে বুড়িগঙ্গা নদীর দিকে যেতে ডানে নদীতে বালুবাহী কয়েকটি নৌকা চোখে পড়ল। ঘাটে ভেড়ানো নৌকাগুলো থেকে কয়েক শ শ্রমিক ঝুড়িতে করে বালু নিয়ে আসছেন। সেই বালু স্তূপ করে রাখা হচ্ছে নদীর পাড়ে। এর পাশে শ্রমিকেরা হাতুড়ি দিয়ে ইট ভাঙছেন। সেই ইটভাঙার ধুলা, রাস্তার ধুলা, বাতাসে উড়ে আসা বালু—সব মিলিয়ে গোটা এলাকা ধুলার রাজ্যে রূপ নিয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার গাবতলী বেড়িবাঁধ এলাকায় কথা হয় সেখানকার বাসিন্দা আশরাফুল আলমের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘এই ধুলার অত্যাচারের কোনো শেষ নাই। শুনি, সিটি করপোরেশন পানি ছিটাচ্ছে। গত ১৫ দিনে এই এলাকায় কোনো পানির গাড়ি দেখলাম না।’

আরেকটু সামনে গিয়ে কথা হয় মধুমতী হাউজিং আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, দিনের বেলায়ও জানালা খুলে রাখা যায় না। এক বেলা খোলা থাকলে বিছানা-চাদরসহ ঘরের আসবাবে ধুলার স্তর জমে যায়।

শুধু গাবতলী ও মোহাম্মদপুর এলাকা নয়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রায় সব এলাকাতেই এখন ধুলার রাজত্ব। নগরের প্রধান-অপ্রধান সড়ক ঘেঁষে লাগানো গাছগুলোর সবুজ পাতায় ধুলার আস্তর দেখে পরিস্থিতি কিছুটা আঁচ করা যায়। এই মুহূর্তে ঢাকায় চলছে মেট্রোরেল ও অ্যালিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বেশ কয়েকটি বড় উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ। পাশাপাশি নগরজুড়ে চলছে বিভিন্ন সেবা সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ি ও আবাসন সংস্থার নির্মাণযজ্ঞ।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) হিসাবে, সংস্থাটি এই মুহূর্তে ১০ কিলোমিটারের মতো সড়কে খোঁড়াখুঁড়ি করছে। পাশাপাশি ওয়াসা, ডেসকো, ডিপিডিসিসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থা ৩০ কিলোমিটারের মতো সড়ক খুঁড়ে রেখেছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) সূত্রে জানা যায়, দক্ষিণে প্রায় ৬০ শতাংশ সড়কে চলছে খোঁড়াখুঁড়ির কাজ। যার মধ্যে ওয়াসার কাজই সবচেয়ে বেশি।

>

শুধু গাবতলী ও মোহাম্মদপুর এলাকা নয়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রায় সব এলাকাতেই এখন ধুলার রাজত্ব।

ডিএনসিসির যান্ত্রিক সার্কেলের ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল হাসনাত মোহাম্মদ আশরাফুল আলম জানান, বর্তমানে গাবতলীসহ উত্তর সিটির বিভিন্ন এলাকার প্রধান প্রধান সড়কে ১০টি গাড়িতে করে প্রতিদিন ৪ লাখ ৫ হাজার লিটার করে পানি ছিটানো হচ্ছে। তবে বেড়িবাঁধ এলাকার অন্তত পাঁচজন বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা গত ১৫ দিনে এই সড়কে ডিএনসিসিকে পানি ছিটাতে দেখেননি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হাবিব বলেন, নদীপাড়ের আচ্ছাদনহীন এই স্তূপগুলো থেকে যখন বালু ট্রাকে করে শহরের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়, তখনো তাতে ঢাকনা দেওয়ার কোনো ব্যবস্থা থাকে না। ফলে তা শহরময় ছড়িয়ে পড়ে। এ ছাড়া ইটভাঙা থেকে যে সূক্ষ্ম ধূলিকণা বের হয়, তা-ও তো আটকানোর কোনো পথ নেই। শুধু গাবতলী কিংবা আমিনবাজার নয়, শহরের মধ্যেও নানা জায়গায় এভাবে উন্মুক্ত পরিবেশে ইট ভাঙতে দেখা যায়।

গত বুধবার মিরপুর ১৪ নম্বর থেকে ভাসানটেক যাওয়ার সড়কে গিয়ে নির্মাণকাজের ধুলা দেখা গেল। সড়কটির উন্নয়নকাজ চলছে প্রায় এক বছর ধরে। দুই পাশের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে সড়কটি সম্প্রসারিত হচ্ছে, পাশাপাশি চলছে নিষ্কাশনের নালা বসানোর কাজ। এই সড়কে প্রতিদিন সকালে একবার পানি ছিটিয়ে যায় সিটি করপোরেশনের গাড়ি। কিন্তু রোদে পানি শুকিয়ে যাওয়ার পর আবার ধুলায় ডুবে যায়। একই অবস্থা দেখা যায় মিরপুরের কালসী রোড, ইসিবি চত্বর, মিরপুর ১২ নম্বর এলাকায়। এ ছাড়া পুরান ঢাকার ধোলাইখাল, দয়াগঞ্জ, যাত্রাবাড়ীর শহীদ ফারুক রোড, গেন্ডারিয়া, জুরাইন ও পোস্তগোলাও ধুলায় ধূসর হয়ে আছে।

বৈশ্বিকভাবে বায়ুদূষণ পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা এয়ার ভিজ্যুয়ালের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, গত ১ থেকে ২৫ নভেম্বর পর্যন্ত আট দিন (দিনের বেশির ভাগ সময়) ঢাকা ছিল বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহর। বাংলাদেশে বায়ুদূষণের উৎস নিয়ে চলতি বছরের মার্চে একটি গবেষণা প্রকাশ করে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংক। তাতে দেখা যায়, ঢাকায় বায়ুদূষণের প্রধান তিনটি উৎসের মধ্যে ইটভাটা ও যানবাহনের কালো ধোঁয়ার পাশাপাশি নির্মাণকাজসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সৃষ্ট ধুলা অন্যতম।