বিপন্ন মানুষের জীবন বাঁচাতে বিপদে ঝাঁপ

কারিতাস বাংলাদেশের উদ্যোগে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের অগ্নিনির্বাপণ মহড়া। দগ্ধ একজনকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছেন ফায়ার  সার্ভিসের দুই কর্মী। গত বৃহস্পতিবার বেলা একটায় চট্টগ্রাম নগরের শিশু একাডেমিতে।  ছবি: প্রথম আলো
কারিতাস বাংলাদেশের উদ্যোগে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের অগ্নিনির্বাপণ মহড়া। দগ্ধ একজনকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছেন ফায়ার সার্ভিসের দুই কর্মী। গত বৃহস্পতিবার বেলা একটায় চট্টগ্রাম নগরের শিশু একাডেমিতে। ছবি: প্রথম আলো

ফোন এলেই বেজে ওঠে প্রস্তুতির ঘণ্টা। মাত্র ৩০ সেকেন্ড সময়। দম ফেলার ফুরসত নেই, লাফ দিয়ে গাড়িতে উঠতে হয়। সাইরেন বাজিয়ে গাড়ি ছোটে ঝড়ের বেগে। সবার মাথায় ভাবনা একটাই—কত দ্রুত আগুন নিভিয়ে বিপদগ্রস্ত মানুষকে উদ্ধার করা যায়। রাজধানীর কাজী আলাউদ্দিন রোডের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের নিয়ন্ত্রণকক্ষে বসে একনিশ্বাসে আগুন নেভানোর এই প্রস্তুতির কথা বলে গেলেন ফায়ারম্যান মোহাম্মদ আলী। তাঁর কথা শেষ না হতেই পাশে বসা আরেক ফায়ারম্যান জিয়াউর রহমান বললেন, বিপন্ন মানুষ সাহায্যের অপেক্ষায় আছে, নষ্ট করার মতো সময় কোথায়?

বছরের পর বছর ধরে এভাবেই হাজার হাজার অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবিলা করে চলছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। দিন নেই, রাত নেই, ঝড়–বৃষ্টি মাথায় করে ছুটে চলে তারা। অপেক্ষা শুধু একটি ফোনের।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন বললেন, গত বছর ১৯ হাজারের বেশি অগ্নিদুর্ঘটনা মোকাবিলা করেছেন তাঁরা। আরও ৮ হাজার নৌ, সড়ক ও অন্যান্য দুর্ঘটনায় তাঁরা উদ্ধারকাজ চালিয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় ১৫ হাজার মানুষকে বিপদ থেকে রক্ষা করেছেন। আর এই সেবা পেতে বিপদাপন্ন মানুষকে শুধু একবারই ফোন করতে হয়েছে।

বঙ্গবাজারের উল্টো দিকে ফুলবাড়িয়ার কাজী আলাউদ্দিন রোডের ভবনটির দিকে তাকালে এর লাল রং–ই বলে দেয়, এটা ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তর। কাজী আলাউদ্দিন রোডের এই কার্যালয় আগে ছিল সদরঘাটে। ১৯৭৮ সালে এটি স্থানান্তরিত হয়। ফায়ার সার্ভিস অবশ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৩৯ সালে, ব্রিটিশ আমলে। তখন এর নাম ছিল বেঙ্গল ফায়ার সার্ভিস। আগুন নেভানোর সময় দম দিয়ে পানির পাম্প চালানো হতো বলে লোকের মুখে এর নাম ছিল ‘দমকল বাহিনী’। যদিও তখন ফায়ার সার্ভিসের সেবা শুধুই বড় বড় শহরকেন্দ্রিক ছিল। গ্রামাঞ্চল ছিল এই সেবার বাইরে।

অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানালেন, ১৯৯৬ সালে দেশে ফায়ার স্টেশন ছিল ২০৬টি, এখন তা বেড়ে হয়েছে ৪১১। শিগগিরই ফায়ার স্টেশনের সংখ্যা হবে ৭০৭। তখন সব উপজেলাও ফায়ার সার্ভিসের সেবার আওতায় আসবে।

কয়েক বছর আগেও ১৪ তলার ওপরে আগুন লাগলে তা নেভানোর সরঞ্জাম ছিল না। এখন ২০ তলায় আগুন লাগলেও নেভানোর সরঞ্জাম রয়েছে। বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুন নেভানোর সময় সেই সক্ষমতা দেখিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

ফায়ার সার্ভিসের আরেকটি সেবা হলো অ্যাম্বুলেন্স। রোগী পরিবহনের জন্য সামান্য অর্থের বিনিময়ে যে কেউ এই সেবা পেতে পারেন। সে জন্য ফায়ার স্টেশনে একটি ফোন করতে হয়। এখন অ্যাম্বুলেন্স আছে ১৮৫টি। নতুন করে ৩৫৭টি অ্যাম্বুলেন্স কেনা হচ্ছে। এতে দেশের সব স্টেশন থেকেই অ্যাম্বুলেন্স সেবা পাওয়া যাবে।

ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের নিচতলায় আছে একটি নিয়ন্ত্রণকক্ষ। বাইরে থেকে কেউ ফোন করলে সেখান থেকে ফোনটি ধরা হয়। নিয়ন্ত্রণকক্ষে ঢুকে দেখা গেল, অনবরত ফোন বাজছে। নিয়ন্ত্রণকক্ষের উপসহকারী পরিচালক ফকর উদ্দিন আহমেদ বললেন, দিনে ৭০ থেকে ৮০টি ঘটনা-দুর্ঘটনার খবর আসে। সব মিলে বছরে ২৫ হাজারের বেশি খবর আসে নিয়ন্ত্রণকক্ষে। তিনি জানান, কোনো খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা ওয়াকিটকির মাধ্যমে ঘটনাস্থলের কাছের ফায়ার স্টেশনকে জানিয়ে দেওয়া হয়। সেই স্টেশন খবর পেয়েই ঘণ্টা বাজিয়ে দেয়। এর পরপরই শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ।

হাকিম আলী নামের এক ফায়ারম্যান বললেন, ‘আমরা সব সময় তৈরি থাকি। তৈরি থাকেন গাড়িচালকও। পানিবাহী গাড়ি নিয়ে আমরা যখন ঘটনাস্থলে যাই, তখন মানুষের চোখে আশার ঝিলিক দেখি। তাঁরা ভরসা পান। কেউ কেউ আবেগে কেঁদে ফেলেন। তাঁদের সেই কান্না আমাদেরও স্পর্শ করে। হয়তো এ কারণেই ফায়ারকর্মীরা ঝুঁকি নিয়ে উদ্ধারে নেমে পড়েন।’

ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান শিকদার বললেন, ফায়ার সার্ভিসে আছেন ৬২ হাজার স্বেচ্ছাসেবক। এঁরাই বাহিনীর আসল শক্তি। যেকোনো দুর্ঘটনায় তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন।

শাহজাহান শিকদারের সঙ্গে কথা বলার সময় পাশে এসে দাঁড়ান এক কর্মী। শাহজাহান তাঁর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন, ‘ওঁর নাম আবুল খায়ের। ফায়ারে যে ৫০ জন ডুবুরি আছেন, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী তিনি। দেশ–বিদেশে নামকরা সব ম্যাগাজিনে তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন হয়েছে। অনেক পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। কোথাও লঞ্চডুবি হলেই খায়েরের ডাক পড়ে।’

খায়েরের কাছে সাহসের গল্প শুনতে চাইলে একগাল হেসে তিনি বললেন, ‘একবার আরিচায় লঞ্চ ডুবে গেল। প্রবল স্রোতে কেউ নামতে পারছিলেন না। প্রশিক্ষিত বাহিনীর লোকজন বলল, এত স্রোতে নামা ঠিক হবে না। ওদের কথা শুনে আমি দিলাম ঝাঁপ। লঞ্চের সঙ্গে রশি বেঁধে পরে উঠেও এলাম। লালবাগে একবার সরু পাইপের ভেতরে ঢুকে আটকে গেলাম। ২০ ফুট লম্বা, কোনোভাবেই বের হতে পারছি না। তখন অক্সিজেন সিলিন্ডার খুলে পাশে রেখে বের হলাম। কোনো কারণে একটু হেরফের হলেই মৃত্যু ছিল অনিবার্য।’ খায়েরের কাছে জানতে চাইলাম, এত ঝুঁকি নেন, ভয় করে না? সরল হাসি হেসে খায়ের বললেন, ‘একটা মানুষকে প্রাণে বাঁচানোর যে আনন্দ, তা আর কিছুতেই মেলে না। তখন নিজের জীবনকে তুচ্ছ মনে হয়। ভয় আসবে কোত্থেকে?’