এবার বড় ধরনের চাপে পড়তে যাচ্ছে মিয়ানমার

অং সান সু চি ও সিনিয়র জেনারেল মিন অং লায়েং। ছবি: এএফপি
অং সান সু চি ও সিনিয়র জেনারেল মিন অং লায়েং। ছবি: এএফপি

রাখাইনে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) করা মামলার শুনানি শুরু হচ্ছে আগামী মঙ্গলবার। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে এই বিচার শেষ হতে কয়েক বছর লাগবে। তবে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের নিশ্চয়তা দিতে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে মিয়ানমারকে অন্তর্বর্তীকালীন কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন আইসিজে।

কূটনৈতিক সূত্রগুলো প্রথম আলোকে জানিয়েছে, মিয়ানমার এই নির্দেশনা না মানলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেবে। কারণ, মিয়ানমার ১৯৫৬ সালে জাতিসংঘের গণহত্যা সনদে সই করেছে। এই সনদে স্বাক্ষরকারী কোনো দেশ আইসিজের কোনো নির্দেশনা অমান্য করে চলতে পারে না। এর ফলে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার অপরাধের অভিযোগে মিয়ানমার বড় ধরনের চাপে পড়তে যাচ্ছে।

গত ১১ নভেম্বর ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সমর্থনে গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মামলাটি করে। গাম্বিয়াও গণহত্যা সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ।

আইসিজের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, নেদারল্যান্ডসের পিস প্যালেসে অবস্থিত আইসিজেতে আগামী মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর) গাম্বিয়ার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা গণহত্যার মামলার শুনানি শুরু হবে। ১১ ডিসেম্বর বক্তব্য উপস্থাপন করবে মিয়ানমার। এরপর ১২ ডিসেম্বর সকালে গাম্বিয়া পাল্টা যুক্তি দেবে মিয়ানমারের বিপক্ষে। আর দুপুরে মিয়ানমার গাম্বিয়ার জবাব দেবে। আইসিজেতে মিয়ানমারের পক্ষে বক্তব্য দেবেন দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি।

মিয়ানমারের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ২০২০ সালের দ্বিতীয়ার্ধে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে নিজের ও দলের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে দেশ ও সরকারের পক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করা ছাড়া সু চির সামনে কোনো পথ নেই। ওই নির্বাচনে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং লায়েংয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার কথা রয়েছে। রাখাইনে রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ পরিচালিত হয়েছে জেনারেল লায়েংয়ের নির্দেশে। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমের শক্তিগুলো তাঁর ওপর ভ্রমণসহ বেশ কিছু নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

>আইসিজেতে গণহত্যার মামলা
আগামী মঙ্গলবার শুরু হচ্ছে শুনানি
১০ ডিসেম্বর মামলার পক্ষে বলবে গাম্বিয়া
১১ ডিসেম্বর মামলার বিপক্ষে বলবে মিয়ানমার
১২ ডিসেম্বর পাল্টা যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবে দুই দেশ
চূড়ান্ত রায়ের আগে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় অন্তর্বর্তী নির্দেশ আসতে পারে


নেদারল্যান্ডসের কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, আইসিজেতে শুনানির সময় আদালতে উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদলের। শুনানি পর্যবেক্ষণে যাওয়া ওই প্রতিনিধিদলে সরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের কয়েকজন প্রতিনিধিও থাকবেন।

কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইসিজেতে ১০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় শুনানির সময় বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধিদল নেদারল্যান্ডসে যাচ্ছে। সেখানে ইউরোপসহ বিশ্বের নানান প্রান্ত থেকে রোহিঙ্গাদের অন্য দলও যাবে। তারা আদালতের বাইরে রাখাইনে নৃশংসতার বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ হবে।

রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে আইসিজেতে মামলা দায়েরের সময় গাম্বিয়া আদালতের কাছে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা এবং তাদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতের জন্য কিছু অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ নেওয়ার আবেদন জানিয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে আদালত কয়েক মাসের মধ্যে নির্দেশনা দিতে পারেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যাসহ সব ধরনের নিপীড়ন, তাদের বাড়িঘর ও সম্পদ ধ্বংস বন্ধ রাখার পাশাপাশি জীবন ও জীবিকার ওপর হুমকি বন্ধ রাখা। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী, সামারিক, আধাসামরিক বাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের গণহত্যা থেকে নিবৃত্ত রাখা এবং গণহত্যার আলামত নষ্ট না করার বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। 

বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় গণহত্যার অভিযোগে যুগোস্লাভিয়ার বিরুদ্ধে ১৯৯৩ সালের ২০ মার্চ মামলা হয়েছিল। আর আইসিজে ওই বছরের ৮ এপ্রিল যুগোস্লাভ সরকারকে বসনিয়ার মুসলমানদের সুরক্ষায় বাড়তি পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ওই প্রসঙ্গ টেনে নেদারল্যান্ডসের কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, গাম্বিয়ার মামলায় মিয়ানমারকে কয়েক মাসের মধ্যে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিতে পারে আইসিজে।

কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা বলছেন, গণহত্যা সনদের রাষ্ট্রপক্ষ হিসেবে আইসিজে যে রায় দেবেন, তা এড়িয়ে চলার সুযোগ নেই মিয়ানমারের। আদালত মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যে রায় দেবেন, দেশটি তা প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রায় বাস্তবায়নের দায়িত্ব নেবে। এর ফলে আইসিজের মামলার প্রক্রিয়াটি রোহিঙ্গা সমস্যার একটি দীর্ঘস্থায়ী সমাধানের সুযোগ তৈরি করবে বলে তাঁদের মত।

প্রসঙ্গত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে গণহত্যা সনদে সইয়ের পর এ পর্যন্ত তিনটি দেশে সংঘটিত গণহত্যার বিচারে আন্তর্জাতিক আদালত রায় দিয়েছেন। এগুলো হচ্ছে সত্তরের দশকের শেষে কম্বোডিয়া, ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডা আর ১৯৯৫ সালে বসনিয়া।

আইসিজের বিচারপ্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গাদের গণহত্যার অভিযোগে আইসিজেতে বিচারপ্রক্রিয়াটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। মিয়ানমার যেহেতু আইসিজের সদস্য, ওই আদালতে যে সিদ্ধান্ত আসবে, তা দেশটি পাশ কাটাতে পারবে না। মিয়ানমারকে তা মানতেই হবে। যদি মিয়ানমার তা না মানে, আইসিজের রায় বাস্তবায়নে নিরাপত্তা পরিষদকেই দায়িত্ব নিতে হবে।

এই সপ্তাহে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মনোযোগ যখন আইসিজের বিচারকক্ষে, ঠিক তার আগেই মিয়ানমার সফর করছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং উয়ি। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির আমন্ত্রণে তিনি গতকাল শনিবার নেপিডোতে পৌঁছেছেন। দুই দিনের এই সফরের সময় মিয়ানমার কীভাবে হেগের আদালতের পরিস্থিতি সামাল দেবে, তা নিয়ে সু চির সঙ্গে ওয়াং উয়ির আলোচনা হবে বলে আভাস দিয়েছে মিয়ানমারের কূটনৈতিক সূত্রগুলো। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের (সিজিএস) পরিচালক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, রোহিঙ্গাদের ওপর তাণ্ডব এবারই প্রথম নয়। এবারের নৃশংসতার সঙ্গে তুলনীয় না হলেও ১৯৭৮ আর ১৯৯২ সালেও রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়াবহ নিপীড়ন চালানো হয়েছে। তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে একসময় ফিরেও গেছে। কিন্তু রাখাইনে নির্যাতনের কারণে আবার বাংলাদেশে আসতে বাধ্য হয়েছে। তবে এবার তাদের ওপর গণহত্যার অপরাধে আইসিজেতে যে মামলা, তা গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এখানে আইনি যে পদক্ষেপের কথা বলা হবে, সেটা ধরে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের দায়িত্ব পালনের বিষয়টি সামনে চলে আসবে। এর ফলে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার অপরাধে মিয়ানমার বড় ধরনের চাপে পড়তে যাচ্ছে।

কিছুটা অপ্রত্যাশিত

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়ায় যুক্ত কূটনীতিকেরা এই প্রতিবেদককে বলেন, রাখাইনে গণহত্যার দায় যে মিয়ানমার এড়াতে পারে না, সেটা তাদের বারবার বলা হয়েছে। বিশেষ করে ২০১৭ সালের নভেম্বরে দুই দেশের প্রত্যাবাসন চুক্তি সইয়ের কাছাকাছি সময়ে এসে তাদের বলা হয়েছিল, এই অপরাধের জের মিয়ানমারকে কয়েক প্রজন্ম ধরে বয়ে চলতে হবে। ২০১৭ সালের সঙ্গে ১৯৭৮ কিংবা ১৯৯২ সালের গুণগত পার্থক্য আছে। আজকের দিনে স্যাটেলাইট আছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আছে। কোথায় কী হচ্ছে, তা নানা সূত্র থেকে খুব সহজেই জানা যায়। রাখাইনে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর কী হয়েছে, তা কারও জানতে বাকি নেই। 

রোহিঙ্গাদের আদি পুরুষের ভিটেমাটি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার অপরাধে দুই বছরের মাথায় মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে নেওয়া হবে—এমনটা ভেবেছিলেন কি না, জানতে চাইলে জ্যেষ্ঠ এক কূটনীতিক এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘মিয়ানমারকে একদিন আদালতে দাঁড়াতে হবে, এ নিয়ে নিশ্চিত ছিলাম। তবে এত তাড়াতাড়ি আইসিজেতে মামলা হবে, তা কিছুটা অপ্রত্যাশিত।’