আইসিজেতে গাম্বিয়াকে সহায়তা করবে তিন দেশ

ফাইল ছবি
ফাইল ছবি

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যা মামলার শুনানিতে গাম্বিয়ার দাবিকে জোরালো করতে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা দেবে বাংলাদেশ, কানাডা ও নেদারল্যান্ডস। আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) এই মামলার শুনানিতে এই তিন দেশের সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। তাই তারা নেপথ্যে থেকে গাম্বিয়াকে এই সহযোগিতা দেবে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি কানাডা ও নেদারল্যান্ডসের কূটনৈতিক সূত্রগুলো প্রথম আলোকে এই তথ্য জানিয়েছে।

২৭ মাস আগে রাখাইনে ঘটে যাওয়া রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার চেয়ে গত ১১ নভেম্বর আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করে গাম্বিয়া। নেদারল্যান্ডসের পিস প্যালেসে আগামীকাল মঙ্গলবার শুরু হচ্ছে এই মামলার তিন দিনের শুনানি। এই শুনানি সামনে রেখে পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হকের নেতৃত্বে ২০ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল আজ সোমবার হেগে যাচ্ছে। প্রতিনিধিদলের মধ্যে আছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয়–বিষয়ক সচিব মাসুদ বিন মোমেন, অস্ট্রেলিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার সুফিউর রহমান, ইরানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত গাউসুল আজম সরকারসহ কয়েকজন কূটনীতিক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি এবং কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের তিনজন প্রতিনিধি।

পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হক গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ওআইসির অন্যতম সদস্য এবং রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানকারী দেশ হিসেবে আদালতে কী ঘটতে যাচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণের জন্য বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল সেখানে যাচ্ছে। বিচারের প্রক্রিয়ায় গাম্বিয়ার প্রতি সমর্থন জানানোর পাশাপাশি সেখানে বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বাংলাদেশ মতবিনিময় করবে।

আইসিজেতে শুনানির সময় গাম্বিয়াকে সহায়তার বিষয়ে জানতে চাইলে মো. শহীদুল হক এই প্রতিবেদককে বলেন, ওআইসির অন্যতম সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ এরই মধ্যে গাম্বিয়ার অনুরোধ অনুযায়ী বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতা দিয়ে আসছে। গাম্বিয়ার প্রয়োজন হলে ভবিষ্যতেও বাংলাদেশ সাধ্য অনুযায়ী সহযোগিতা দেবে।

নেদারল্যান্ডসের একটি কূটনৈতিক সূত্র গতকাল এই প্রতিবেদককে জানিয়েছে, বাংলাদেশের পাশাপাশি কানাডা ও নেদারল্যান্ডসও গাম্বিয়াকে নেপথ্যে থেকে সহায়তা করবে। বিশেষ করে এবার আইসিজের শুনানি হবে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষার স্বার্থে অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপের বিষয়ে। জনসমক্ষে প্রকাশিত ও প্রচারিত তথ্যের ভিত্তিতে গাম্বিয়া আদালতে মিয়ানমারের বিপক্ষে নিজের যুক্তি তুলে ধরবে। আর গাম্বিয়ার সেই যুক্তি খণ্ডন করবে মিয়ানমার। পরে মিয়ানমারের বিপক্ষে পাল্টা যুক্তি তুলে ধরবে গাম্বিয়া। এর আগে বাংলাদেশ ও কানাডার কাছ থেকে রোহিঙ্গা গণহত্যা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পাশাপাশি এ-সম্পর্কিত পর্যবেক্ষণ জানতে চাইবে গাম্বিয়া। তবে আদালতে গাম্বিয়া যে বক্তব্য ও পর্যবেক্ষণ উপস্থাপন করবে, তা অবধারিতভাবে জনসমক্ষে প্রকাশিত তথ্য হতে হবে।

>মিয়ানমারের বিরুদ্ধে করা মামলায় গাম্বিয়াকে বাংলাদেশের পাশাপাশি কানাডা ও নেদারল্যান্ডস সহায়তার কথা জানিয়েছে
পররাষ্ট্রসচিবের নেতৃত্বে ২০ সদস্যের প্রতিনিধিদল যাচ্ছে
শুনানিতে যোগ দিতে গেছেন অং সান সু চি
বিভিন্ন দেশ থেকে যাচ্ছেন রোহিঙ্গা প্রতিনিধিরা
নেপথ্যে থেকে গাম্বিয়াকে সহযোগিতা দেবে তিন দেশ


কানাডার একটি কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো এরই মধ্যে গাম্বিয়াকে আইসিজেতে সমর্থনের কথা জানিয়েছেন। ফলে রাখাইনে গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করতে গাম্বিয়াকে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে তৈরি আছে কানাডা। ইতিমধ্যে মিয়ানমারবিষয়ক কানাডার বিশেষ দূত বব রায়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল গতকাল নেদারল্যান্ডসে পৌঁছেছে।

তথ্য–উপাত্ত দিয়ে গাম্বিয়াকে সহযোগিতার মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ–মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বিষয়টি থাকতে পারে বলে ঢাকার কর্মকর্তারা মনে করেন। প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনে পরিবেশ তৈরি হয়েছে কি না, রোহিঙ্গারা কেন নিজের ইচ্ছায় ফিরে যাচ্ছে না, এ বিষয়গুলো গাম্বিয়াকে জানাতে পারে বাংলাদেশ। 

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি কোথায় আটকে আছে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্প্রতি তা পর্যালোচনা করেছে। ওই পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের পূর্বশর্ত হিসেবে রাখাইনের পরিবেশ স্বাভাবিক করতে মিয়ানমার রাজি হয়েছিল। কিন্তু রাখাইনের পরিবেশ স্বাভাবিক না হওয়ায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আসা থামছে না। রাখাইনে সহিংসতার খবর নানা সূত্র থেকে এখনো আসছে। গত ২৯ নভেম্বর রাখাইনে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে স্থলমাইন বিস্ফোরণে মিয়ানমারের এক নাগরিক প্রাণ হারিয়েছে। 

বিশাল এলাকাজুড়ে অন্তর্বর্তীকালীন শিবির রোহিঙ্গাদের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হিসেবে উল্লেখ করে ওই পর্যালোচনায় বলা হয়েছে, রাখাইনের লা ফু খুয়াং এলাকায় মিয়ানমার সরকার ৩০ হাজার রোহিঙ্গার জন্য থাকার ব্যবস্থা করেছে। সেখানে সর্বোচ্চ পর্যায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে। অথচ এ বিষয়গুলো কখনো মিয়ানমার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে জানায়নি। অন্য সূত্র থেকে পাওয়া এ তথ্যগুলো সম্পর্কে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারাও জানে।

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পাশাপাশি রাখাইনের শান্তি ও উন্নয়নের জন্য জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বাধীন কমিশন বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছিল। অং সান সু চির পরামর্শে আনান কমিশন গঠিত হলেও মিয়ানমার সরকার ওই কমিশনের সুপারিশ অগ্রাহ্য করেছে। কমিশন রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দেওয়ার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণসহ বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিয়েছিল। বিশেষ করে, আনান কমিশন মিয়ানমার সরকারকে ১৯৮২ সালের কুখ্যাত ও বৈষম্যমূলক নাগরিকত্ব আইনে পরিবর্তন আনার বিষয়টি বিবেচনা করতে বলেছিল। ওই আইনের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ১৯৮২ সালে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমার এসব সুপারিশের একটিও বাস্তবায়ন করেনি। আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার বক্তব্যে এসব বিষয় আসতে পারে বলে মনে করে নেদারল্যান্ডসের সূত্রগুলো। তারা বলছে, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অন্তর্বর্তীকালীন পদক্ষেপ গ্রহণের আবেদনে এ বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হিসেবে আদালতে বিবেচিত হতে পারে। 

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইসিজেতে গণহত্যার মামলার শুনানি চলাকালে নেদারল্যান্ডসে বেশ কিছু অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশসহ ওআইসির সদস্য কয়েকটি দেশ এবং একাধিক আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা এসব আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে।

জানা গেছে, নেদারল্যান্ডসের স্থানীয় সময় আজ দুপুর ও বিকেলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং আইসিজের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলাদা মতবিনিময়ের দায়িত্ব নিচ্ছে নেদারল্যান্ডসে কর্মরত একটি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা। কাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিচারমন্ত্রী আবুবাকার তামাদুর সম্মানে ওআইসির চার সদস্যদেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ এক সংবর্ধনার আয়োজন করেছে। আইসিজেতে গাম্বিয়ার মামলার প্রক্রিয়ায় যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আছে, সেটার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ওই আয়োজন করা হচ্ছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, আইসিজের শুনানিতে অংশ নেওয়ার জন্য গতকাল নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি।