অভিযানে ভর করে সক্রিয় দুদক

সরকারঘোষিত চলমান ‘শুদ্ধি অভিযান’ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করলেও তা সংস্থাটি কতটা কাজে লাগাতে পেরেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। এ অভিযানকে সাধারণ মানুষ স্বাগত জানিয়েছে এবং দুর্নীতিবাজদের মধ্যে মৃদু ঝাঁকুনি তৈরি করেছে। এর পাশাপাশি দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতার প্রসঙ্গটিও সামনে এসেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার ও নাগরিকের সমর্থন নিয়ে দুদকের যতটা এগিয়ে যাওয়ার কথা ছিল, ততটা এগোতে পারেনি। বিশেষ করে প্রভাবশালী ও আলোচিত কিছু দুর্নীতিবাজকে আইনের আওতায় আনতে না পারায় সমালোচিত হচ্ছে ব্যাপক আইনি ক্ষমতার অধিকারী এ সংস্থাটি। দুর্নীতিবাজদের গ্রেপ্তার, তাদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান, তদন্ত এবং অভিযোগপত্র প্রদানসহ আইনি প্রক্রিয়ায় আরও কোনো সংগঠনকে এত ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।

এ প্রসঙ্গে দুদকের বক্তব্য হচ্ছে, দুর্নীতির মতো জটিল বিষয় অনুসন্ধান ও তদন্ত করে অভিযুক্তকে বিচারের মুখোমুখি করতে সংস্থাটির সক্ষমতার অভাব এখনো রয়েছে। প্রশিক্ষণ, লোকবলসহ যেসব সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সেগুলো কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

 চলমান ‘শুদ্ধি অভিযান’, দুদকের অনুসন্ধান ও গ্রেপ্তারের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং দুর্নীতির ব্যাপকতা ঘিরে আলোচনা–সমালোচনার মধ্যে আজ ৯ ডিসেম্বর পালিত হতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস। এবার দিবসের প্রতিপাদ্য ‘আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ।’ ২০০৭ সাল থেকে দুদক দিবসটি পালন শুরু করে, ২০১৭ সাল থেকে সরকারিভাবে দিবসটি পালন করা হচ্ছে।

বর্তমান কমিশন দায়িত্ব পালন করছে প্রায় সাড়ে তিন বছর। এই সাড়ে তিন বছরে দুদকের দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৬৯৩ জন। এর বেশির ভাগই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। এ ছাড়া ঘুষ নেওয়ার সময় ফাঁদ পেতে হাতেনাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৭২ জন।

দুদকের তথ্যমতে, সংস্থাটির দায়ের করা মামলায় বিচারিক আদালতে সাজার হার ৭০ শতাংশের মতো। আর উচ্চ আদালতে সেটা ৫৩ শতাংশের বেশি। দুদকের কর্মকর্তারা দুর্নীতি দমনে এটাকে ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে দেখেছেন। যদিও দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ মনে করেন, দুদকের মামলায় শতভাগ সাজা হওয়া উচিত।

রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের পাশাপাশি প্রশাসনিক দুর্নীতির বিরুদ্ধে গত ১৮ সেপ্টেম্বর অভিযান শুরুর পর থেকে আশাবাদের পাশাপাশি আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। ইতিমধ্যে অভিযান কিছুটা স্তিমিত হয়েছে। যদিও বড় দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান দৃশ্যমান হয়নি। অভিযানে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের বরাতে যেসব প্রভাবশালীর নাম এসেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। কয়েক বছর ধরে বড় দুর্নীতির হোতা হিসেবে আলোচনায় আছেন বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু এবং ফারমার্স ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান মহীউদ্দীন খান আলমগীরসহ কয়েকজন।

দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, রাঘববোয়াল বা রুই–কাতলা কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের সক্ষমতার ঘাটতি ছিল। সেটা অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা গেছে। আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত যে তথ্য আছে, তাতে অভিযান বন্ধ হবে না। সাম্প্রতিক অভিযানে অনুসন্ধানের আওতায় এসেছেন ১৮৭ জন। এই তালিকা আরও বড় হবে।’

তবে সরকারের সবুজসংকেত পেয়ে র‌্যাব–পুলিশ অভিযান শুরুর পর দুদকের সক্রিয় হওয়ার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযান শুরুর পর দুদকের তালিকায় ১৮৭ জনের নাম এসেছে। মামলা হয়েছে ১৬টি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, দুদকের আইনি ক্ষমতা আগে থেকেই আছে। কিন্তু সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে যে রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা পাওয়া গেছে, তাতে করে সুবিধা হয়েছে সংস্থাটির জন্য। তিনি মনে করেন, এর মাধ্যমে দুদকের জন্য দৃষ্টান্ত তৈরির সুযোগ তৈরি হয়েছে। দুদক যদি নেপথ্যের গডফাদারদের আইনের আওতায় আনতে পারে, তাহলে এ অভিযান সফল হতে পারে।

দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) প্রতিবছরই দুর্নীতির ধারণা সূচক প্রকাশ করে। ২০০১ থেকে ২০০৫ পর্যন্ত টিআইয়ের সূচকে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। টিআইয়ের সর্বশেষ ২০১৮ সালে প্রকাশিত সূচকে ১৮০ দেশের মধ্যে দুর্নীতিগ্রস্ত তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩। এর আগের বছর অবস্থান ছিল ১৭। টিআইয়ের এই সূচক নিয়ে ক্ষমতাসীন দল সব সময়ই সমালোচনা করেছে, প্রশ্ন তুলেছে টিআইয়ের গবেষণা পদ্ধতি নিয়ে। টিআইবি যুক্তি দিয়ে এই সূচকের গ্রহণযোগ্যতা তুলে ধরার চেষ্টা করে যাচ্ছে।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযানে দুটি বিষয় পরিষ্কার হয়েছে। একটি হলো, দুর্নীতির শিকড় অনেক গভীরে বিস্তৃত। সরকারি দলের কেউ কেউ এবং সরকারের ভেতরেও অনেকে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। দ্বিতীয়টি হলো, দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতার বিষয়টি এখন আর স্লোগানে সীমাবদ্ধ নেই, এটা এখন রাজনৈতিক অঙ্গীকার। এ কারণে মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেড়েছে। তাঁর মতে, সরকারের সদিচ্ছা এবং মানুষের প্রত্যাশাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার বড় দায়িত্ব এখন দুদকের।

তবে দুদক–সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুদকের আইনি কাঠামোয় বেশ কিছু সংস্কার হয়েছে। অর্থ পাচার–সংক্রান্ত অপরাধ কমিয়ে আনতে কাঠামোগত বেশ কিছু পরিবর্তন এসেছে। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট গঠন করা হয়েছে। দুর্নীতি দমনে দুদকের সক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে।

এ মুহূর্তে দুর্নীতি দমনে করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে দুদকের সাবেক চেয়ারম্যান গোলাম রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বেশ কিছু ক্ষেত্রে দুদকের সক্ষমতা বেড়েছে। আবার মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ অনুসন্ধানে তাদের ক্ষমতা সীমিত হয়েছে। তাঁর মতে, দুর্নীতি এমন একটি বিষয় যে এটাকে একসঙ্গে নির্মূল করা খুবই কঠিন। আইনি কাঠামোয় দুদকের অনেক ক্ষমতা। সাবেক চেয়ারম্যান হিসেবে তাদের আরও সক্রিয় হতে হবে বলে আমার মনে হয়।