এখন কথাও বলে না মানবাধিকার কমিশন

মানবাধিকার কমিশন
মানবাধিকার কমিশন

বিচারবহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে মৃত্যু, নির্বিচার আটক ও গুম—এই চার ধরনের ঘটনাকে সবচেয়ে বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন বলে মনে করা হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী গত ১০ বছরে বন্দুকযুদ্ধে ১ হাজার ৫৯৯ জন নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও এ বছর ১০ বছর পূর্ণ করল। কিন্তু এক দশকে মাত্র একটি বিচারবহির্ভূত হত্যার তদন্ত করেছে কমিশন, সেটাও প্রায় পাঁচ বছর আগে।

এই প্রেক্ষাপটে আজ পালিত হতে যাচ্ছে বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘মানবাধিকার সুরক্ষায় তারুণ্যের অভিযাত্রা’।

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে অভিযান পরিচালনা করে যশোরের কেশবপুর থানা–পুলিশ। কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন রজব আলী নামের এক ব্যক্তি। এ ঘটনা তদন্ত করে ওই বন্দুকযুদ্ধের ঘটনাকে ‘হত্যাকাণ্ড’ বলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। ঘটনার সঙ্গে পুলিশের বক্তব্যের অসংগতিও চিহ্নিত করে কমিশন বলেছিল, এই কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনার সত্যতা নেই। কমিশনের ওই তদন্তের ঘটনা সাড়া ফেলে। কিন্তু ওই প্রথম, ওই শেষ তদন্ত।

মানবাধিকার সংরক্ষণ এবং উন্নয়ন—এই দুই উদ্দেশ্য নিয়ে ২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। শুরু থেকেই কমিশন গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকারের ইস্যুতে তদন্ত বা কথা বলার ক্ষেত্রে নিস্পৃহতা দেখানো শুরু করে। কমিশনের কাজ হলো তদন্তের ক্ষেত্রে বেছে বেছে আলোড়ন সৃষ্টিকারী ঘটনা বেছে নেওয়া। আবার সেই সব ঘটনাই বেছে নেয়, যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে রাষ্ট্রের কোনো সংস্থা জড়িত থাকে না।

মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেছেন, ‘বন্দুকযুদ্ধের মতো অনেক বড় বড় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। মানুষের প্রত্যাশা ছিল, মানবাধিকার কমিশন এসব বিষয়ে শক্ত একটা অবস্থান নেবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা কোনো উদাহরণ দিতে পারছি না, যাতে বলব যে কমিশন তাদের দায়িত্ব পালন করেছে। দিন দিন আরও শৈথিল্য দেখা যাচ্ছে কাজে।’

কমিশনের কাছে মানবাধিকার লঙ্ঘন কী
২০১৮ সালে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে কমিশনের সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে রোহিঙ্গা সংকটকে প্রথমে স্থান দেওয়া হয়েছে। এর আগের বছরের প্রতিবেদনেও প্রথমে ছিল রোহিঙ্গা সংকট।

কমিশনের এবারের (২০১৮) প্রতিবেদনের দ্বিতীয় অবস্থানে আছে নিখোঁজের কথা। এরপর ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড’। সেখানে বলা হয়েছে, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড একপ্রকার নিকৃষ্ট ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন। এতে বলা হয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কিছু সদস্যের দ্বারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটনের কথিত অভিযোগ সরকারের ভাবমূর্তি-সংকটের সৃষ্টি করছে।’

>

বিশ্ব মানবাধিকার দিবস আজ। জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ১০ বছর পূর্ণ করল। এ পর্যন্ত একটি বিচারবহির্ভূত হত্যার তদন্ত করেছে কমিশন।

 মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের সময় ২০১৪ একটি বিচারবহির্ভূত হত্যার তদন্ত হয়েছিল। কমিশনের তদন্তের অবস্থা প্রসঙ্গে মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন যা দেখছি, তাতে মনে হয়, কথা বলার শক্তিও কমিশন হারিয়ে ফেলেছে।’

অবশ্য কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বললেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যার তদন্ত করার জন্য সুনির্দিষ্ট ডিপার্টমেন্ট আছে। এত জনবল আমার নাই যে এসব করা যাবে।’

কমিশন এখন যেসব অরাষ্ট্রীয় অপরাধ নিয়ে কাজ করে, সেগুলোর তদন্তেও তো রাষ্ট্রীয় বাহিনীই সক্রিয় থাকে। সেখানে কমিশনের কাজ করার দরকার কী—এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, ‘ঘটনার গুরুত্ব একেকজনের কাছে একেক রকম। আমাদের কাছে যেটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে, সেগুলো আমরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত করেছি।’

তদন্ত না করলেও গত বছরের মে মাসে শুরু হওয়া মাদকবিরোধী অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর করণীয় নিয়ে ‘নির্দেশিকা’ তৈরি করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। কমিশন বলছে, অভিযানের সময় বিচারবহির্ভূত এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তারা উদ্বিগ্ন। গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচনের রাতে রাজনৈতিক কারণে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে গৃহবধূ ধর্ষণ, ২০১৭ সালে বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণী ধর্ষণের ঘটনা তদন্ত করে কমিশন। এর মধ্যে সুবর্ণচরের ঘটনায় কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পায়নি কমিশন। আর রেইনট্রিতে ‘বড় মানবাধিকার লঙ্ঘন ঘটেছে’ বলে তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করে।

বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নিস্পৃহ থাকলেও পার্শ্ববর্তী ভারত ও নেপালের মানবাধিকার কমিশন এ ব্যাপারে সক্রিয়। সম্প্রতি ভারতের তেলেঙ্গানা রাজ্যে এক নারীকে গণধর্ষণ ও পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার পর গত শুক্রবার পুলিশের সঙ্গে কথিত ‘এনকাউন্টার’ বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্ত চার ব্যক্তি। এই হত্যার বিষয়ে সরব হয় দেশটির জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। বিচারবহির্ভূত এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে তদন্তের ঘোষণা দেয় সংস্থাটি।

সামর্থ্যের ব্যবহারটুকুও করে না
মানবাধিকার কমিশন আইন ১৪ এর ৬ ধারা অনুযায়ী, কোনো কর্তৃপক্ষের কাছে মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতিবেদন চেয়ে না পেলে কমিশন এ–সংক্রান্ত তথ্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে পারবেন। আর রাষ্ট্রপতি সেই প্রতিবেদন সংসদে উপস্থাপন করার ব্যবস্থা করবেন। মানবাধিকারকর্মীরা বলেন, বাংলাদেশে রাষ্ট্রপতিকে কোনো কাজ করার তাগিদ এই একটিমাত্র আইনেই আছে। কিন্তু গত ১০ বছরে মাত্র একবার প্রতিবেদন চেয়ে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার তালিকা রাষ্ট্রপতিকে দিয়েছে কমিশন।

ঢাকার বাইরে এখন খুলনা, রাঙামাটি, কক্সবাজার ও গোপালগঞ্জে মানবাধিকার কমিশনের শাখা অফিস আছে। এসব অফিসে অভিযোগ পড়ে নামমাত্র।

রাজধানীর মিরপুরে শিশু গৃহকর্মী খাদিজা ২০১৩ সালে নির্যাতনের শিকার হয়। মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ করার পর পাঁচ বছর কেটে গেলেও ব্যবস্থা না নেওয়ায় গত বছরের ডিসেম্বরে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে চিলড্রেন চ্যারিটি ফাউন্ডেশন। খাদিজার মামলার আইনজীবী আবদুল হালিম বলেন, ‘গত জানুয়ারিতে রিটের শুনানিতে আদালত বলেন, কোনো মানুষ জেগে ঘুমিয়ে থাকলে তাকে ডেকে তোলা যায় না। আইনের অধীনে দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পরও জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ঘুমাচ্ছে।’