অজয় রায়কে শেষ শ্রদ্ধা

অধ্যাপক অজয় রায়ের প্রতি সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তাঁর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হয়। ঢাকা, ১০ ডিসেম্বর। ছবি: আবদুস সালাম
অধ্যাপক অজয় রায়ের প্রতি সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য তাঁর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হয়। ঢাকা, ১০ ডিসেম্বর। ছবি: আবদুস সালাম

সকাল সাড়ে ১০টা। তখনো আসেনি মরদেহ। শহীদ মিনারে সুহৃদেরা জড়ো হচ্ছেন ক্রমে। হাতে শ্রদ্ধাঞ্জলি।

একুশে পদকজয়ী পদার্থবিদ অধ্যাপক অজয় রায়কে শেষ শ্রদ্ধা জানানো হলো। কবি, সাহিত্যিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, সংগঠন ও আত্মীয়-সুহৃদদের ভালোবাসায় সিক্ত হলেন এই শিক্ষক। বেলা ১১টায় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এই আয়োজন করে।

শ্রদ্ধা জানিয়ে জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, ‘অজয় রায় ও আমি সমসাময়িক ছিলাম। আমরা একই বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করি। একই বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছি। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণতান্ত্রিক চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজে একসঙ্গে কাজ করেছি। অজয়ের মৃত্যু আমার জন্য গভীর শোকের বিষয়। আমি তার স্মৃতির প্রতি আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাই।’

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি হাবিবুল্লাহ সিরাজী বলেন, ‘বাংলা একাডেমি বিশেষ করে তাঁর কথা স্মরণ করবে। তাঁর বিকল্প আর কখনো হবে না। আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের পাশাপাশি, বিজ্ঞানচিন্তায়ও তিনি অবদান রেখেছেন। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এই আশা, তারা যেন অজয় রায়কে অনুসরণ করে।’

বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, ‘অজয় রায় একজন অসাধারণ বৈজ্ঞানিক, পদার্থবিজ্ঞানী, নৃতত্ত্ববিদ ছিলেন। আমাদের যে বাংলা সন চালু হয়েছে, তার ইতিহাস প্রবর্তনের ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা ছিল সর্বপ্রধান। “বাংলা ও বাঙালির ইতিহাস” তিনি ও আমি বাংলা একাডেমি থেকে চার খণ্ডে সম্পাদনা করেছি। তাতে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও অসাধারণভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।’

অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, ‘অধ্যাপক অজয় রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের একজন ছিলেন। তাঁর ছেলেকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, এটা গোটা জাতির জন্য মর্মান্তিক ব্যাপার। তিনি বিচার চেয়ে মামলা করেছিলেন। মামলার বিচার হওয়ার আগেই তাঁর মৃত্যু হলো। মাঝখানে চার বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেছে। আমরা চাই, অপরাধীরা শাস্তি পাক। তবে দেশে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা উন্নত না হলে এই জঙ্গিবাদী হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে না।’

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আমরা ১৯৯২ সালে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন করেছিলাম শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে। ১৯৯২ সাল থেকে গত ২৮ বছর অধ্যাপক অজয় রায় আমাদের সঙ্গে ছিলেন। তিনি নির্মূল কমিটির অন্যতম উপদেষ্টা হিসেবে ছিলেন। আমাদের যেকোনো আন্দোলনে মৌলবাদের বিরুদ্ধে, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সব সময় তিনি সোচ্চার ছিলেন। ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ ছিল তাঁর আদর্শ।’

অজয় রায়ের সন্তান অনুজিৎ রায় বলেন, ‘পিতাকে হারানোর বেদনা মর্মে মর্মে আমি অনুভব করি। তিনি শুধু আমার পিতা নন, তিনি একজন বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা, একুশে পদকপ্রাপ্ত বিজ্ঞানী, লেখক ও গবেষক। তাঁর গুণ বলে শেষ করা যাবে না। আমার বড় ভাই অভিজিৎ রায়ের হত্যার বিচার তিনি দেখে যেতে পারেননি। হয়তো দেখে যেতে পারলে তিনি কিছুটা স্বস্তিবোধ করতেন। তিনি ইচ্ছা করলে বিদেশে সপরিবারে থাকতে পারতেন। শুধু বাংলাদেশের টানেই সপরিবারে এখানে ছিলেন। বাবা বলতেন, “এটা আমাদের দেশ। এখান থেকে আমরা যাব কেন?” যে ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন আলোকিত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন, তা যদি অর্জিত হয়, সেখানেই হবে সার্থকতা।’

শহীদ মিনারে আরও শ্রদ্ধা জানাতে আসেন সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান, মানবাধিকারকর্মী খুশী কবির, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি জিয়াউদ্দিন তারিক আলী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ, কবি মুহাম্মদ সামাদ, কবি তারিক সুজাত, সংগীতশিল্পী ফকির আলমগীর প্রমুখ।

শহীদ মিনারে অজয় রায়কে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। শ্রদ্ধা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ ও জগন্নাথ হলে কিছু আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে অজয় রায়ের শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী বারডেম হাসপাতালে মরদেহ হস্তান্তর করা হবে।

গতকাল সোমবার দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাজধানীর বারডেম জেনারেল হাসপাতালে মারা যান অজয় রায়।