বন্ধুর পথের হার না-মানা যাত্রী

ইজিবাইক নিয়ে ছুটছেন জীবনসংগ্রামে হার না মানা যাত্রী রানী বর্মণ।  ছবি: প্রথম আলো
ইজিবাইক নিয়ে ছুটছেন জীবনসংগ্রামে হার না মানা যাত্রী রানী বর্মণ। ছবি: প্রথম আলো

যখন বাবা মারা যান, তখনো তাঁর শিশু বয়স। সেই বয়সেই দরজির দোকানে কাজ করে সংসার চালিয়েছেন। দুই বোনকে বিয়েও দেন। এরপর নিজেও বিয়ে করে চেয়েছিলেন সুখের সংসার করতে। কিন্তু ‘ভবঘুরে’ স্বামীর নির্যাতনে যেন সংসার হয়ে ওঠে ‘নরক’। একদিন স্ত্রী–সন্তান ফেলে উধাও স্বামী। জীবনের তাগিদে পথে নামতে হয় যাত্রীকে। যাত্রী নামের এই নারী এখন শহরের অলিগলিতে ইজিবাইকে যাত্রী পরিবহন করে পাড়ি দিচ্ছেন জীবনের বন্ধুর পথ।

জীবনসংগ্রামে হার না–মানা যাত্রীকে এবার সুনামগঞ্জ জেলা পর্যায়ে শ্রেষ্ঠ জয়িতার সম্মাননা দেওয়া হয়েছে। নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করা নারী ‘ক্যাটাগরিতে’ গত সোমবার নারী নির্যাতন প্রতিরোধ পক্ষ ও বেগম রোকেয়া দিবস উপলক্ষে তাঁকে এই সম্মাননা দেয় জেলা প্রশাসন।

যাত্রী রানী বর্মণ (৩৩) সুনামগঞ্জ পৌর শহরের নবীনগর এলাকায় বসবাস করেন। মা স্বেতা রানী বর্মণ (৭০), ছেলে অভিজিৎ দত্ত (৮), দুই মেয়ে ঝুমা দত্ত (৬) ও রুমা দত্তকে (৩) নিয়ে তাঁর সংসার। ‘ভবঘুরে’ স্বামী হৃদয় দত্তের কোনো খোঁজ নেই। অভিজিৎ এবার তৃতীয় শ্রেণিতে উঠবে। যাত্রী রানী বর্মণ জানান, তাঁর বয়স যখন সাত-আট বছর, তখন বাবার সঙ্গে সুনামগঞ্জ শহরে আসেন। মা ও দুই বোন তখন সঙ্গে ছিলেন। কয়েক বছর পর বাবা মারা যান। এরপর তিনি দরজির দোকানে কাজ নেন। তাঁর আয়েই চারজনের সংসার চলত। একসময় নিজের আয়ে ছোট দুই বোনকে বিয়ে দেন। বছর দশেক আগে নিজে বিয়ে করেন হৃদয় দত্ত নামের এক ব্যক্তিকে। হৃদয় পাগলাটে ধরনের, নেশা করেন। নানা সময় তাঁকে নির্যাতন করতেন। মাঝেমধ্যে তাঁর খোঁজ থাকত না। বছর দুয়েক আগে একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে স্বামীকে একটি ইজিবাইক কিনে দেন তিনি। কিন্তু স্বামী নিয়মিত সেটি চালাতেন না। একপর্যায়ে কৌশলে স্বামীর কাছ থেকে ইজিবাইক চালানো শিখে নেন যাত্রী রানী। চলতি বছরের শুরুর দিকে স্বামী একদিন তাঁকে মারধর করে ঘর থেকে বের হয়ে যান। অসহায় হয়ে পড়েন তাঁরা। কোনো উপায় না পেয়ে স্বামীর ইজিবাইক নিয়ে একদিন বেরিয়ে পড়েন শহরে। প্রায় এক বছর ধরে তিনি সুনামগঞ্জ পৌর শহরে ইজিবাইক চালাচ্ছেন।

আলাপকালে যাত্রী রানী বর্মণ বলেন, প্রথমে লোকজন নানা কথা বলত। অনেকেই ইজিবাইকে উঠতে চাইত না। কিন্ত এসব তিনি গায়ে মাখতেন না। এখন সবাই তাঁকে চেনে। লোকজনও সহযোগিতা করেন। পুরো পরিবারের খরচ তিনি ইজিবাইক চালিয়ে মেটান। একই সঙ্গে ঋণের কিছু কিস্তি বাকি আছে, সেগুলোও দিচ্ছেন। যাত্রী রানী বর্মণ বলেন, ‘ঘরে বসে থাকলে তো না খেয়ে মরতে হবে। বাঁচার তাগিদে রাস্তায় নেমেছি। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া করিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে চাই। শুরুতে রাস্তায় নানা কটু কথা শুনতে হতো। এখন অবশ্য সবাই সহযোগিতা করে।’

জেলা মহিলা পরিষদের সভাপতি গৌরী ভট্টাচার্য বলেন, ‘যাত্রী রানী অন্য নারীদের জন্য প্রেরণা। সমস্যা-সংকটে মনোবল না হারানোর উদাহরণ তিনি। মহিলা পরিষদের এক কর্মী হিসেবে শুরু থেকেই তাঁর কাজে আমরা উৎসাহ দিচ্ছি। তাকে আমাদের সবার সহযোগিতা করা উচিত।’