নান্নুর কলার গলি

কলার দোকানে নান্নু, ৪০ বছর ধরে কলা বিক্রি করছেন িতনি। গত রোববার সকালে।
কলার দোকানে নান্নু, ৪০ বছর ধরে কলা বিক্রি করছেন িতনি। গত রোববার সকালে।

‘কিনু গোয়ালার গলি’। কিনু গোয়ালার নামে গলি। রবীন্দ্রনাথ ‘বাঁশি’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘দোতলা বাড়ির/ লোহার–গরাদে–দেওয়া একতলা ঘর/ পথের ধারেই।/ লোনা–ধরা দেওয়ালেতে মাঝে মাঝে ধসে গেছে বালি, / মাঝে মাঝে স্যাঁতা পড়া দাগ।’

ঢাকার আরামবাগে একটি গলি আছে—কানাগলি। সেই গলির দেয়ালেও স্যাঁতা পড়ে গেছে। বিবর্ণ দেয়ালে রাজনৈতিক রঙিন পোস্টার, ঘর আর মেস ভাড়ার লিফলেট। সেই দেয়ালে সবকিছু ছাপিয়ে দড়িতে ঝুলছে কলা। নানা আকারের, নানান জাতের—শুধু কলা আর কলা। গলির মাথায় ছোট্ট একটি দোকান। কলার। নান্নু তার মালিক। কলার কারণেই গলির নামকরণ হয়ে গেছে ‘নান্নুর কলার গলি’। শুধু এলাকায় নয়, আশপাশের মহল্লার লোকেও এ নামেই চেনেন গলিটিকে। আরামবাগ প্রধান সড়কের দক্ষিণে কাউন্সিলরের কার্যালয়ের পাশে এই গলি। এই গলির পাশ দিয়ে ফকিরাপুলে যাওয়া যায়।

গতকাল রোববার সকালে নটর ডেম কলেজের পাশে বইয়ের একটি দোকানে ‘নান্নুর কলার গলি’ কোথায় জিজ্ঞেস করলে দোকানি সহজেই
বুঝিয়ে দেন—ওই দিকে। পথের ধারে বল নিয়ে খেলছিল আট বছরের বালক ধ্রুব। খেলা ফেলে ছুটে চলে সে। নিয়ে যায় নান্নুর কলার গলিতে। গিয়ে দেখা যায়, তিন বছরের ছোট্ট মেয়ে ফাতেমাকে নিয়ে দোকানে বসে আছেন নান্নু। মুখে গোঁফ দাড়ি। টি–শার্ট আর লুঙ্গি পরা। মুখে হাসি লেগেই থাকে। পুরো নাম জানতে চাইলে দাঁত বের করে বললেন—নান্নু দেওয়ান। বয়স ৫৫ বছর। বাড়ি চাঁদপুরের মতলবে। ১৯৮০ সালে ঢাকায় কাজের খোঁজে এসেছিলেন। তখন গোঁফের রেখাই গজায়নি। কাজ বিশেষ জোটেনি। অগত্যা কিছু পুঁজি নিয়ে কলার পসরা সাজিয়ে বসেন এই গলিতে। বেচাকেনা জমে উঠলে একপর্যায়ে জায়গা ভাড়া নিয়ে তৈরি করেন ছোট্ট দোকান। তারপর কেটে গেছে প্রায় ৪০ বছর। একই জায়গায় একই পণ্যের বিপণন। কখন কে জানে, লোকমুখে গলির নামটি হয়ে গেছে তাঁর নামে।

এলাকার ব্যবসায়ী পিন্টু শর্মা মজা করে বলেন, ঢাকা শহরে কত বিখ্যাত মানুষ আছেন। কত পয়সাওয়ালা মানুষ। কিন্তু গলি বা রাস্তার নাম হয়েছে কয়জনের নামে? সিটি করপোরেশনের বালাম বইয়ে হয়তো ‘নান্নুর কলার গলি’ নামটি নেই। কিন্তু আছে মানুষের মুখে।

নান্নুর দোকানে কলা কিনতে এসেছেন পার্শ্ববর্তী ছয়তলা বাড়ির মালিক শহীদ হোসেন। বললেন, চল্লিশ বছর ধরে নান্নুকে দেখছেন। অতিরিক্ত লাভ করে না। সততা নিয়ে চলে।

আরও কয়েকজন এসে যোগ দেন নান্নুর গল্প শোনাতে। নান্নুর কলার গলিতে দেয়ালের সঙ্গে আটকানো দড়িতে সারা দিনই কলা ঝোলে। চুরি যায় না। বাচ্চারাও আচমকা ছিঁড়ে নিয়ে দৌড় দেয় না; বরং সুবিধাবঞ্চিত বাচ্চাদের মাঝে মাঝে কলা খেতে দেন বিনা মূল্য।

নান্নু বলেন, এত বছরে কলার ওপরেই বেঁচে আছেন। প্রথমে দোকান ভাড়া নিয়েছিলেন আড়াই শ টাকায়। এখন তিন হাজার। বাসা ভাড়া দিতে হয় দেড় হাজার টাকা। যা আয় হয় তা দিয়ে কোনোরকমে চলেন। তারপরও ভালোই আছেন। তেজগাঁও রেলস্টেশনের কাছে কলার আড়ত থেকে নানা জাতের কলা নিয়ে আসেন। তবে সাগর ও চাঁপা কলারই চাহিদা বেশি।

৪০ বছরে নান্নুর ভাগ্যের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। তিনি খুব সাধারণ জীবন যাপন করেন। ফাতেমা ছাড়াও তাঁর দুটি সন্তান আছে। তারা পড়াশোনা করে। নান্নু বলেন, বাকি জীবনটা তিনি এভাবেই কাটিয়ে দিতে চান। তাঁর নামে গলির নাম—কেমন লাগে—এমন প্রশ্নে বিগলিত হয়ে হাসেন নান্নু। বলেন, ‘সবই আল্লার হুকুম।’