কেবল বাংলাদেশ সংক্ষুব্ধ হতে পারে, গাম্বিয়া নয়: মিয়ানমার

ছবি: রয়টার্স
ছবি: রয়টার্স

রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচারের শুনানিতে মিয়ানমারের আইনজীবী ক্রিস্টোফার স্টকার গাম্বিয়াকে নামমাত্র অভিযোগকারী বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন, আদালতে গাম্বিয়া আবেদন করলেও মূলত আবেদনটি করেছে ইসলামি সহযোগী সংস্থা (ওআইসি)। মামলার অর্থায়ন করছে ওআইসি। তাঁর দাবি, গাম্বিয়া গত অক্টোবরে মিয়ানমারকে কূটনৈতিক পত্র (নোট ভারবাল) দেওয়ার এক সপ্তাহ আগেই ওআইসি আইনগত পদক্ষেপ শুরু করেছে। তিনি বলেন, মিয়ানমারের ঘটনাবলিতে যদি কোনো দেশ সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকে, সেটা হওয়ার কথা বাংলাদেশের। গণহত্যার প্রশ্নে অন্য যেসব দেশ মামলা করেছে, তারা সবাই সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। গাম্বিয়া সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত নয়।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ শুনানির দ্বিতীয় দিনে স্টকার এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, ওআইসির ঢাকা ঘোষণায় ‘গণহত্যা বিশেষণ’ ব্যবহার করা হয়নি। এতে জাতিগত নির্মূলের কথা বলা হয়েছে।

আইনজীবী স্টকার বলেন, গাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গত সেপ্টেম্বরে যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেখানেও রোহিঙ্গা গণহত্যার কথা বলেননি। ওআইসির মন্ত্রী পর্যায়ের কমিটি, যার সভাপতি হিসেবে গাম্বিয়া এই আবেদন করেছে, ওই কমিটিতেও মামলার অর্থায়নের বিষয় আলোচিত হয়। ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনেও আন্তর্জাতিক আদালতে মামলার বিষয়ে যে সিদ্ধান্ত হয়, সেখানেও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে নৃশংসতার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এগুলোয় গণহত্যার ভিত্তি হিসেবে কোনো তথ্যপ্রমাণের কথা বলা হয়নি।

আইনজীবী ক্রিস্টোফার স্টকার ওআইসি কীভাবে মামলাটিতে করেছে, তার বিবরণ তুলে ধরেন। মামলাটি ওআইসি করেছে—এমন ধারণা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন তিনি।

ওআইসির প্রতিভূ হিসেবে গাম্বিয়া মামলা করায় বিষয়টি আদালতের এখতিয়ারের আওতায় আসে না। ওআইসি ছাড়া আরও কারা অর্থায়ন করছে তা স্পষ্ট নয়। গাম্বিয়া আইসিজের বিধিমালাকে পাশ কাটানোর জন্য ওআইসির হয়ে মামলা করেছে। কেননা, সনদভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বিরোধের মামলা কেবল একটি রাষ্ট্রই করতে পারে, কোনো সংস্থা বা জোট নয়। আদালতকে এই মামলা বিবেচনা করতে হলে বিরোধটি অবশ্যই মিয়ানমার ও গাম্বিয়ার মধ্যে হতে হবে। গাম্বিয়ার অভিযোগ এবং বিরোধ ওআইসির তথ্যের ভিত্তিতে।

গাম্বিয়ার সঙ্গে বিরোধের ভিত্তি নেই দাবি করে তিনি বলেন, তথ্যানুসন্ধান দলের রিপোর্ট এবং ওআইসির প্রস্তাবের ভিত্তিতে মিয়ানমারের কাছে যে চিঠি দেওয়া হয়েছিল, তা থেকে বিরোধ তৈরি হতে পারে না। ওই চিঠিতে মিয়ানমারের প্রতি গণহত্যা সনদের বাধ্যবাধকতা পূরণের জন্য যে দাবি জানানো হয়েছিল, তার জবাবের জন্য যতটা সময় অপেক্ষা করা হয়েছে, তা যথেষ্ট কি না প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, ওই চিঠি থেকে কোনো বিরোধের জন্ম হয় না।

গণহত্যা সনদের অধীনে গাম্বিয়ার যদি সত্যিই কোনো বিরোধ থাকত, তাহলে দেশটি শুরু থেকে সে কথা বলেননি কেন? গণহত্যা সনদের কথা তারা তুলেছে শুধু ওআইসির তরফে মামলার প্রস্তুতি গ্রহণ সম্পন্ন হওয়ার পর। মিয়ানমারের ঘটনাবলিতে যদি কোনো দেশ সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকে, সেটা হওয়ার কথা বাংলাদেশের। কিন্তু বাংলাদেশ গণহত্যা সনদের প্রযোজ্য ধারাটি গ্রহণ না করায় কোনো মামলা করার অধিকার রাখে না। কার্যত, লাওস ছাড়া মিয়ানমারের অন্য কোনো প্রতিবেশীই এমন মামলা করতে পারে না।

গণহত্যার প্রশ্নে অন্য যেসব দেশ মামলা করেছে, তারা সবাই সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। গণহত্যা সনদের আওতায় কোনো আবেদন করতে হলে সরাসরি সংক্ষুব্ধ হওয়ার প্রশ্নটিকে অস্বীকার করা যায় না। মিয়ানমার গণহত্যা সনদের ৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী তার পূর্ণ সম্মতি না দেওয়ায় গাম্বিয়ার বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আইসিজে এ ক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা নিতে পারে না।

স্টকার বলেন, আদালত যদি অন্তর্বর্তী আদেশ দেয় তাহলে সেগুলো প্রতিপালনের বাস্তবতা ও বিবেচনায় নিতে হবে। মিয়ানমার সনদ লঙ্ঘনের মতো কোনো আচরণ করেছে বলে স্বীকার করে না। সুতরাং, বিরোধের গুণগত দিক (মেরিট) বিচার না করে আদালত কোনো অন্তর্বর্তী আদেশ দিতে পারেন না। গাম্বিয়া যেসব অন্তর্বর্তী ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চেয়েছে, সেগুলো কেন দেওয়া উচিত নয়, তার দফাওয়ারি ব্যাখ্যা দেন ক্রিস্টোফার স্টকার।

স্টকারের পর আইনজীবী মি. ফোবে ওকোয়া তাঁর বক্তব্যের শুরুতে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার নির্দেশনার বিষয়ে কথা বলছেন। তিনি বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে চলমান প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন যে অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার নির্দেশনা দেওয়া হলে প্রত্যাবাসন বাধাগ্রস্ত হবে। বিভিন্ন জাতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়ায় সহায়তা করছে। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা এবং জাতিসংঘ উন্নয়ন সংস্থা বাস্তুচ্যুতদের পুনর্বাসনের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করছে। ইউএনএইচসিআর মাঠপর্যায় থেকে প্রত্যাবাসন তদারক করবে এবং কোনো রকমের ঝুঁকি দেখলে তারা তা জানাতে পারবে। সুতরাং, প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়াকে চলতে দেওয়া উচিত। সবচেয়ে বড় বোঝা যাদের ঘাড়ে পড়েছে, তারা মিয়ানমারের সঙ্গে একটি সম্মত কার্যবিবরণীতে প্রত্যাবাসনের বিষয়ে একমত হয়েছে। বাংলাদেশ মিয়ানমারে আশু কোনো গণহত্যার ঝুঁকির কথা বলছে না।

আরেক আইনজীবী অধ্যাপক সাবাস তাঁর বক্তব্যে গণহত্যা সনদের যে ব্যাখ্যা গাম্বিয়া দিয়েছে, তা যথার্থ নয় বলে দাবি করেছেন। জাতিগত শুদ্ধি অভিযান এবং গণহত্যার প্রশ্নে সার্বিয়া বনাম ক্রোয়েশিয়া মামলার রায়ের উল্লেখ করে বলেন গাম্বিয়া ওই মামলার রায়ের বিস্তারিত ব্যাখ্যা ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে গেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। ওই সব মামলায় গণহত্যা সনদের যে ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে গাম্বিয়ার দাবি সংগতিপূর্ণ নয় বলেও তিনি দাবি করেন।

জাতিসংঘ তদন্তকারীদের রিপোর্টের ভিত্তিতে কিছু আচরণের বা কর্মকাণ্ডের প্রবণতাকে গণহত্যার উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিহিত করা হয়েছে। গণহত্যার উদ্দেশ্য আসলে ছিল কি না, তার কোনো প্রমাণ নেই বলে সাবাস দাবি করেন। গণহত্যার উদ্দেশ্য ছিল—তার সম্ভাবনা প্রমাণ করতে আবেদনকারী পক্ষ ব্যর্থ হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

অধ্যাপক সাবাস বলেন, সাধারণ দেশীয় অপরাধগুলোর ক্ষেত্রেও উদ্দেশ্য বা ইনটেন্ট প্রমাণ করতে হয়। তা না হলে অপরাধের বিচারে ফারাক হয়। যেমন খুনের উদ্দেশ্যে হত্যা আর ঘটনাক্রমে খুন—এর মধ্যে পার্থক্য আছে। অন্তর্বর্তী আদেশের আবেদনের ক্ষেত্রে এই গণহত্যার উদ্দেশ্য প্রমাণিত হয় না, বরং ধারণাপ্রসূত অবস্থান থেকে তা বলা হচ্ছে।

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে জোর করে তাড়িয়ে বাংলাদেশে পাঠানোর দাবি উল্লেখ করে প্রফেসর সাবাস বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রাক্‌-তদন্তেও বলা হয়েছে যে জোরপূর্বক বিতাড়নকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। সুতরাং, রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক বিতাড়নের বিষয়টি মানবতাবিরোধী অপরাধ হলেও গণহত্যা নয়। জাতিসংঘের স্পেশাল র‍্যাপোর্টিয়ার ইয়াং হি লি তাঁর কোনো প্রতিবেদনে গণহত্যার কথা বলেননি। রয়টার্সের সাক্ষাৎকারে তিনি গণহত্যার স্মারকচিহ্নগুলো দেখা যাচ্ছে বললেও পরবর্তী সময়ে কোনো বিবৃতি বা প্রতিবেদনে তিনি তা বলেননি। জাতিসংঘের গণহত্যাবিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি অ্যাডামা দিয়ে ও গণহত্যার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন সম্ভাব্য গণহত্যা। তিনি নৃশংসতার কথা বলেছেন। গত ১৫ মাসে তিনি একবারও মিয়ানমারে গণহত্যার কথা বলেননি। অথচ কম্বোডিয়া, শ্রীলঙ্কা ও সুদানের কথা বলেছেন।

বিদ্রোহ দমনের প্রয়োজনে ক্লিয়ারেন্স অপারেশন চালানো হচ্ছে ষাটের দশক থেকে। কখনো তো এই বিশেষণ ব্যবহারের বিষয়ে প্রশ্ন ওঠেনি উল্লেখ করে প্রফেসর সাবাস বলেন হঠাৎ করে ২০১৭ সাল থেকে এটি বলা হচ্ছে। সাবাস বলেন, জাতিসংঘের তদন্ত দলের অনুসন্ধান ত্রুটিপূর্ণ। ওই তদন্ত রিপোর্টকে আদালতের উপেক্ষা করা উচিত।

আইনজীবী সাবাস বলেন, আবেদনে কোথাও হতাহত হওয়ার হিসাব দেওয়া হয়নি। তিনটি গ্রামের কয়েক শ মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। আবেদনে যে জাতিসংঘে তদন্তের কথা বলা হয়েছে, তাতে ১০ হাজার পর্যন্ত রোহিঙ্গার প্রাণহানির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই সংখ্যার কোনো প্রমাণ দেওয়া হয়নি। গ্রাম ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তার প্রমাণ দেওয়া হয়নি। ক্রোয়েশিয়ার মামলায় সাড়ে ১২ হাজার মৃত্যুর কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু সেই সংখ্যা জনসংখ্যার তুলনায় কম বলে গণ্য করা হয়েছিল। মিয়ানমারে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার মধ্য ১০ হাজারের প্রাণহানির তথ্যের ক্ষেত্রেও একই প্রশ্ন ওঠে। গ্রাম ধ্বংসের ক্ষেত্রে গণহত্যার উদ্দেশ্য প্রমাণিত হয়নি। ক্রোয়েশিয়ার মামলার রায়ে বলা হয়েছে জোরপূর্বক বিতাড়ন জনগোষ্ঠীকে নির্মূলের উদ্দেশ্য হিসেবে গণ্য করা হয়নি। এ ক্ষেত্রেও তেমনটি গণ্য হওয়া উচিত। আদালতের উচিত আবেদনটি প্রত্যাখ্যান করা।