কেরানীগঞ্জে আগুনের ঘটনায় মালিকের গাফিলতি ছিল: ফায়ার সার্ভিস

ঢাকার কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ার হিজলতলা আবাসিক এলাকার প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড আইন মেনে স্থাপন করা হয়নি। প্লাস্টিকের মতো দাহ্য পদার্থের এই কারখানাটির যেসব নিয়ম মেনে স্থাপন করার কথা, তার বেশির ভাগই নেই। প্রাথমিক তদন্তে বোঝা যাচ্ছে, কারখানা পরিচালনায় মালিকের গাফিলতি রয়েছে।

ইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে গতকাল (১১ ডিসেম্বর) বিকেলে আগুন লাগে। দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া দুই ভাই আলম ও রাজ্জাকের স্বজনদের আহাজারি। হিজলতলা, চুনকুটিয়া, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা। ছবি: জাহিদুল করিম
ইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডে গতকাল (১১ ডিসেম্বর) বিকেলে আগুন লাগে। দগ্ধ হয়ে মারা যাওয়া দুই ভাই আলম ও রাজ্জাকের স্বজনদের আহাজারি। হিজলতলা, চুনকুটিয়া, দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ, ঢাকা। ছবি: জাহিদুল করিম

আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টর আবুল হোসেন প্রথম আলোকে এ তথ্য জানিয়েছেন। সকাল থেকে ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের চার সদস্যর একটি প্রতিনিধিদল তদন্ত করছে।

এর আগে এ কারখানায় ছোটবড় মিলিয়ে চারবার আগুন লেগেছে। কারখানার পাশেই তিনতলা একটি বাড়ির মালিক মো. মাসুদ প্রথম আলোকে এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এ কারখানায় প্রায়ই আগুন লাগে। সে কারণে কেউ বাড়ি ভাড়া নিতে চায় না।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টর আবুল হোসেন বলেন, আবাসিক এলাকায় কারখানা করা হয়েছে। কারখানার নিরাপত্তা রক্ষায় যা যা থাকা উচিত, যে পরিবেশ রাখা উচিত, তা এখানে ছিল না।

এদিকে যথাযথ পরিবেশ নিশ্চিত না করে কারখানা পরিচালনার অভিযোগ এনে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে গত ৫ নভেম্বর মামলা করেছে। মামলার ফয়সালা হওয়ার আগেই ঝরে গেল নয়জন মানুষের প্রাণ। অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন আরও ২৪ জন।

আজ সকাল থেকে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের পাঁচ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোল্লা জালাল উদ্দিন ঘটনাস্থল থেকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তদন্ত করছি। তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো মন্তব্য করব না।’

তবে ফায়ার সার্ভিস সদর দপ্তরের উপসহকারী পরিচালক কাজী নজমুজ্জামান গতকাল জানান, এর আগেও কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

অন্যদিকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী এবং কেরানীগঞ্জের সাংসদ নসরুল হামিদ গতকাল সন্ধ্যায় দগ্ধ লোকজনকে দেখতে হাসপাতালে গিয়ে বলেছেন, কারখানাটির অনুমোদন ছিল না বলে জানা গেছে। নির্দিষ্ট এলাকার বাইরে থাকা কারখানাগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে তিনি স্থানীয় সরকার ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে বলেছিলেন। কিন্তু কারখানাগুলো সরানো যায়নি।

গতকাল আগুন লাগার পর বিকেল ৪টা ২৯ মিনিটে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করে। আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায়।

আজ সকালে প্রাইম প্লেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের কারখানায় গিয়ে মালিক ও শ্রমিকদের কাউকে পাওয়া যায়নি। কারখানার নিযুক্ত সাতজন নিরাপত্তাকর্মীকে সেখানে পাহারা দিতে দেখা গেছে। নিরাপত্তাকর্মীদের সুপারভাইজার সাকিল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, কারখানার ভেতর বয়লারের পেছনে গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হতো। গতকাল বিকেলে প্রথমে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়। এরপর সেখানকার নিরাপত্তা কর্মীরা প্রথমে ফায়ার এক্সটিংগুইশার (অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র) দিয়ে চেষ্টা করা হয়। তবে আগুন নেভানো যায়নি।

ঘটনার পর থেকে কারখানার মালিক নজরুল ইসলাম পলাতক। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত মামলা হয়নি। তবে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি হয়েছে। কারখানাটিতে বিরিয়ানির প্লেট, প্যাকেট ও একবার ব্যবহার উপযোগী (ওয়ান টাইম ইউস) গ্লাস তৈরি করা হয়। কারখানায় কর্মীর সংখ্যা প্রায় ২০০। যে ইউনিটে আগুন লাগে, সেখানে কর্মরত ছিলেন ৮০ জন।

এর আগে চলতি বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে পুরান ঢাকার চুড়িহাট্টায় আগুন লেগে ৭০ জন নিহত হন। ২০১৬ সালের ১০ সেপ্টেম্বর টাম্পাকো প্যাকেজিং ফ্যাক্টরিতে আগুনে নিহত হন ২৪ জন।

শ্বাসনালি পুড়েছে ৩২ জনেরই
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শঙ্কর পাল গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে ভর্তি অগ্নিদগ্ধ লোকজনের অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। প্রত্যেকের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। ভর্তি রোগীদের অবস্থা এতই খারাপ যে তাঁরা কোনো কথাই বলতে পারছেন না।

দগ্ধ ব্যক্তিদের ১০ জনের বয়স ১৪ থেকে ২০ বছর পর্যন্ত। বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট সূত্রে জানা গেছে, দগ্ধ ব্যক্তিদের মধ্যে আলম, জিনারুল ইসলাম, ফারুক, মেহেদী ও রাজ্জাকের শরীরের শতভাগ পুড়ে গেছে। ৯০ শতাংশ পুড়েছে দুর্জয় ও সুজনের। ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত পুড়েছে ১০ জনের।