খালেদা জিয়ার মুক্তি: আইনি পথ ফিকে হচ্ছে বিএনপির কাছেও

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ফাইল ছবি

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তির আর কোনো আশা দেখছেন না বিএনপির তিনজন আইনজীবী। তাঁরা মনে করছেন, আদালত জামিন আবেদন খারিজ করে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন তাতে খালেদা জিয়ার কারাবাস দীর্ঘই হবে। এই আদেশের ফলে বিএনপির চেয়ারপারসনকে কারা তত্ত্বাবধানে দীর্ঘসময় হাসপাতালেই থাকতে হবে সেটাই প্রতীয়মান হয়েছে। আইনজীবীরা বলছেন, আপিল বিভাগে জামিন আবেদন খারিজ হওয়ায় অন্য আরেকটি মামলায়ও জামিনের পথ আটকে গেল।

বৃহস্পতিবার আপিল বিভাগ জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন খারিজ করে দেন। এই মামলায় তাঁর সাত বছরের সাজা হয়েছে। এ ছাড়া আরও একটি মামলা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তাঁর ১০ বছরের সাজা হয়েছে। এ দুটি মামলা ছাড়া বিএনপির চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে হওয়া অপর ৩৪টি মামলায় ইতিমধ্যে জামিন হয়েছে। বিএনপি নেতাদের আশা ছিল, চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় জামিন পেলে অন্য মামলাটিতে খালেদা জিয়া জামিন পাবেন। জামিন আটকে যাওয়ায় এবং আদালত খালেদা জিয়াকে উন্নত চিকিৎসা দিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে আদালত নির্দেশ দেওয়ায় শিগগির দলীয় চেয়ারপারসনের মুক্তির সম্ভাবনা দেখছেন না।

বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে কারাবন্দী আছেন। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা আদালতকে বলেছেন, খালেদা জিয়ার উন্নত চিকিৎসা দরকার। মানবিক কারণে আমরা খালেদা জিয়ার জামিন চাইছি। তাঁর অবস্থা এমন যে তিনি পঙ্গু অবস্থায় চলে গেছেন। হয়তো ছয় মাস পর তাঁর অবস্থা আরও খারাপ হবে। আর কোথাও গিয়ে লাভ নেই। এ জন্য আমরা বারবারই আদালতের কাছে আসছি, বলছি, মানবিক কারণে খালেদা জিয়াকে জামিন দেওয়া হোক।’

অন্যদিকে জামিনের বিরোধিতা করে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতকে বলেন, খালেদা জিয়ার যেসব রোগ, তা দীর্ঘমেয়াদি। তিনি বলেন, খালেদা জিয়া ডায়াবেটিসে ভুগছেন ২০ বছর ধরে। উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন ১০ বছর ধরে। আর্থরাইটিস ভুগছেন ৩০ বছর ধরে। মেডিকেল প্রতিবেদনও বলছে, খালেদা জিয়ার অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। তাঁর ডায়াবেটিসে ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আর তাঁর যেসব রোগ, সেগুলোর চিকিৎসা বাংলাদেশে সম্ভব।

দুই পক্ষের বক্তব্য শুনে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ খালেদা জিয়ার জামিন আবেদন সর্বসম্মতিক্রমে খারিজ করে দিয়েছেন। তবে আদালত খালেদা জিয়ার সম্মতিতে তাঁকে উন্নত চিকিৎসা দিতে বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন আইনজীবী সদস্য রায়ের পর নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, এই রায়ের পর রাজনীতির মাঠে ‘মুক্ত খালেদা জিয়া’কে পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে এসেছে। সরকারের মনোভাব পরিষ্কার বোঝা গেছে। তা ছাড়া আদালত মানবিক বিবেচনায় বা খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের বিষয়টি অগ্রাধিকার দিয়ে যে জামিন দেবেন না সে ব্যাপারে তাঁরা নিশ্চিত হয়ে গেলেন। তিনি বলেন, সাজা হওয়া সত্ত্বেও যে খালেদা জিয়া জামিন পাওয়ার যোগ্য এই পয়েন্টে ভবিষ্যতে জামিন আবেদন করা যেতে পারে। সেটা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

বিএনপির এই নেতা মনে করেন, তাঁদের নেত্রী রাজনৈতিক কারণে বন্দী আছেন। এই কারণেই তাঁকে জামিন দেওয়ার ব্যাপারে সরকারপক্ষ বিরোধিতা করছে। তাই রাজপথে সরকারকে মোকাবিলা করে, চাপে ফেলে খালেদা জিয়ার মুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ওই নেতা বলেন, চেয়ারপারসন জেলে, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমান বিদেশে। এ অবস্থায় দেশে বিএনপির কোনো নেতার পক্ষে জোরালো আন্দোলন গড়ে তোলাটা কঠিন।

বিএনপি চেয়ারপারসনের আইনজীবী ও দলটির ভাইস চেয়ারম্যান জয়নুল আবেদীন প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের একটি আদেশ কেন এল সেটা তাঁরা বুঝতে পারছেন না। আদেশের পুরো বিষয়টি পাওয়ার পর তাঁরা আইনি পরবর্তী কী ব্যবস্থা নেওয়া যায় সে ব্যাপারটি দেখবেন। এই আইনজীবী নেতা মনে করেন, সরকারের কারণেই খালেদা জিয়া জামিন পাচ্ছেন না। জয়নুল আবেদীন বলেন, ‘আমরা বসব। দেখি কি করা যায়।’

সম্প্রতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা বলেছিলেন, এখন থেকে তারা সভা-সমাবেশ করতে পুলিশের অনুমতির জন্য অপেক্ষা করবেন না। তখন মনে করা হচ্ছিল বিএনপি হয়তো কিছুটা কঠোর অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু বুধবার দলটির মহাসচিব বলেছেন, তারা এখনই সংঘাতে যেতে চান না। মূলত পুলিশ একটি কর্মসূচি করতে না দেওয়ার পর এই মন্তব্য করেন বিএনপির মহাসচিব। তা ছাড়া আজ জামিন ঘিরে হাইকোর্ট এলাকায় পুলিশ কঠোর অবস্থান নেওয়ার কারণে অন্যান্য দিনের মতো বিএনপির নেতা-কর্মীদের উপস্থিতি সেভাবে দেখা যায়নি।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, বিএনপি আইনি পথে আছে। তাঁরা আইনকে শ্রদ্ধা করেন। কিন্তু জামিন পাওয়ার যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও খালেদা জিয়া জামিন পাচ্ছেন না। এ অবস্থায় দলের করণীয় আছে। নেতা কর্মীরাও ভোটাধিকার হরণকারী এই সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ। সাধারণ মানুষও নানা কারণে ক্ষুব্ধ। ফলে সরকারের পতন হবেই। এক প্রশ্নের জবাবে এই নেতা বলেন, বিএনপি আন্দোলনে নেই তা নয়। আন্দোলন করছে। সরকার কিন্তু বিএনপির আন্দোলন রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা করতে পারছে না। তারা পুলিশ-প্রশাসন লাগিয়ে দিচ্ছে। গুম-খুন হচ্ছে নেতা-কর্মীরা। এই নেতা বলেন, খালেদা জিয়া বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। তাকে এভাবে আটকে রাখার দীর্ঘস্থায়ী কোনো ভাবেই সফল হবে না।