বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসন-সংকট, পুরোনো শিক্ষাক্রম

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিজয় ৭১ ও স্মৃতিস্তম্ভ। সম্প্রতি ময়মনসিংহে।  ছবি: প্রথম আলো
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বিজয় ৭১ ও স্মৃতিস্তম্ভ। সম্প্রতি ময়মনসিংহে। ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় এবার ছাত্রদের চেয়ে ছাত্রীরা বেশি উত্তীর্ণ হয়েছেন। এর মধ্যে ৫৮৫ জন ছাত্রী ও ৫২৩ জন ছাত্র। এমন অবস্থায় এত ছাত্রীকে আবাসিক হলে জায়গা দেওয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে প্রশাসন। কারণ, আবাসন–সংকটের কারণে এমনিতেই ছাত্রীদের হলগুলোতে অনেক বেশি ছাত্রী থাকেন। খাবার কক্ষসহ (ডাইনিং রুম) বিভিন্ন কক্ষকে ‘গণরুম’ বানিয়েও সবাইকে জায়গা দিতে হিমশিম খাচ্ছে প্রশাসন।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বলছেন, কৃষিভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণায় এগিয়ে থাকা এই প্রতিষ্ঠানের এখন প্রধান সমস্যা আবাসন–সংকট। এ ছাড়া এখানকার শিক্ষাক্রম (কারিকুলাম) ও পাঠ্যসূচি (সিলেবাস) পুরোনো। দীর্ঘদিন ধরে তা পরিবর্তনের চেষ্টা করা হলেও এখন পর্যন্ত তা সফল হয়নি। ফলে শিক্ষার্থীরা নতুন প্রযুক্তির শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছেন। যদিও প্রশাসন বলছে, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে নতুন শিক্ষাক্রম চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ময়মনসিংহে ১ হাজার ২০০ একর জায়গা নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৬১ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাবিষয়ক শাখার তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে শিক্ষার্থীসংখ্যা ৭ হাজার ৯২৩। ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে শিক্ষার্থী। যেমন ২০০৯ সালে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হতো ৮৫০ জন শিক্ষার্থী। ১০ বছর পর ২০১৯ সালে ভর্তি হয়েছিলেন ১ হাজার ২৩০ জন। অবশ্য নতুন শিক্ষাবর্ষে (২০২০) কিছু আসন কমানো হয়েছে।

শিক্ষার্থীর তুলনায় আবাসিক সুবিধা অপ্রতুল। বর্তমানে প্রায় ৮ হাজার ছাত্রছাত্রীর বিপরীতে ১৩টি আবাসিক হলে মোট আসন আছে ৫ হাজার ৮৭৬টি। এর মধ্যে ছেলেদের হল ৯টি, ছাত্রীদের ৪টি। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে এখন ছাত্রীদের হার ৪৩ শতাংশ।

ছাত্রীদের ৪টি হলে মোট আসন আছে ২ হাজার ৪০০-এর মতো।দিন দিন ছাত্রীদের সংখ্যা বাড়তে থাকায় তাঁদের আবাসন–সংকট আরও তীব্র হচ্ছে।

অপর দিকে ছাত্রদের ৯টি হলে মোট আসন ৩ হাজার ৪৭৫টি। তা-ও চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। ১৯৯৮ সালের পর ছাত্রদের জন্য কোনো নতুন হল হয়নি। দ্বিতীয় বর্ষে পড়ুয়া শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের ছাত্র মো. রাকিবুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সংকট কাটাতে অনেক কক্ষে তিনজনের রুমকে চারজন বা পাঁচজনের রুম বানানো হয়েছে। তারপরও প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া ছাত্রদের সমস্যায় পড়তে হয়। প্রথম বর্ষের ছাত্রদের কক্ষগুলোতে ছয়-সাতজন করেও থাকেন।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বলেন, কষ্ট করে ছাত্ররা কোনো না কোনোভাবে থাকার ব্যবস্থা করতে পারলেও ছাত্রীদের সমস্যায় পড়তে হয়।

সুলতানা রাজিয়া হলের ছাত্রী শামীমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, আবাসন সমস্যার কারণে তাঁকে দুই বছর ‘গণরুমে’ থাকতে হয়েছিল। হলের ডাইনিং রুমের এক পাশে খাবারের ব্যবস্থা রেখে আরেক পাশে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে ২৬ জনের মতো থাকতে হয়। স্বাভাবিকভাবেই সেখানে কিছু সমস্যা হয়। তবে তৃতীয় বর্ষে এসে ভালো কক্ষে থাকার সুযোগ হয় তাঁর।

জানা গেছে, ছাত্রী হলের টিভি, নামাজ ও রিডিং রুমকেও কয়েক মাসের জন্য গণরুম বানিয়ে ভর্তি হওয়া নতুন ছাত্রীদের থাকতে দেওয়া হয়। সংকট নিরসনে বিশ্ববিদ্যালয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একটি অংশেও ছাত্রীদের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগে স্নাতকোত্তরপড়ুয়া এক ছাত্রী বলেন, এসব সমস্যার কারণে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে কেওয়াটখালী এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রবিষয়ক ভারপ্রাপ্ত উপদেষ্টা এ কে এম জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রীদের আবাসিক সমস্যা নিয়ে তাঁরাও বিপদে আছেন। যেমন, প্রায় এক হাজার আসনের বেগম রোকেয়া হলে ১ হাজার ৪০০-এর বেশি ছাত্রী থাকেন। ফলে ভর্তি হতে যাওয়া নতুন ছাত্রীদের নিয়ে তাঁরা চিন্তায় আছেন।

উপাচার্য লুৎফুল হাসান জানান, আবাসন–সংকট কাটাতে ছাত্রীদের জন্য দুটি আবাসিক হল (প্রতিটি ১ হাজার ২০০ শয্যা করে) নির্মাণের দরপত্র চূড়ান্ত হয়েছে। ছাত্রদের জন্যও একটি বহুতল হল নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এগুলো হওয়া পর্যন্ত সবার সহযোগিতা চান তিনি।

শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০০২ সালে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার পদ্ধতিতে (ছয় মাসে এক সেমিস্টার) পাঠদান শুরু হয়। সামান্য কিছু পরিবর্তন ছাড়া সেমিস্টার পদ্ধতি চালুর সময় শিক্ষাক্রমে বড় কোনো পরিবর্তন আনা হয়নি। তাই এখন পর্যন্ত পুরোনো শিক্ষাক্রমেই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান। ২০০৯ সালে তৎকালীন উপাচার্য এম এ সাত্তার মণ্ডল শিক্ষাক্রম হালনাগাদের উদ্যোগ নিলেও তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তখন শুধু মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ শিক্ষাক্রম হালনাগাদ করেছিল।

কৃষি অনুষদের শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘গবেষণা ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সেরা হলেও আমাদের পড়তে হচ্ছে মান্ধাতার আমলের সিলেবাসে, যার অনেক কিছুই বর্তমান সময়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। অনেক বিভাগের বিভিন্ন কোর্সে রয়েছে বিষয়বস্তুর পুনরাবৃত্তি। তাই খুব শিগগির আধুনিক ও বিশ্বমানের শিক্ষাক্রম দরকার।’

 কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বলেন, শিক্ষাক্রম হালনাগাদ করতে বিভিন্ন কোর্সের বিষয়বস্তু পরিবর্তনসহ কোর্স ক্রেডিট (পড়ানোর নির্ধারিত মানদণ্ড) কমানোর নির্দেশনা ছিল। ক্রেডিট কমাতে পুরোনো ও সময়ের বিবেচনায় অপ্রয়োজনীয় কিছু কোর্স বাদ যাওয়ার কথা। কিন্তু কিছুসংখ্যক শিক্ষক চাইছিলেন না তাঁর কোর্সটি বাদ পড়ে যাক। মূলত এই কারণেই একাধিকবার উদ্যোগ নেওয়ার পরও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি।

ভেটেরিনারি অনুষদের ডিন নাজিম আহমাদ বলেন, অতিরিক্ত কোর্স ক্রেডিট শিক্ষার্থীদের জন্য বোঝা। পাঠ্যক্রম হালনাগাদের সময় বিষয়বস্তু পরিবর্তনসহ ক্রেডিট কমাতে নির্দেশনা রয়েছে। পাঁচ বছরের ডিভিএম ডিগ্রির জন্য প্রস্তাবিত নতুন শিক্ষাক্রমে ক্রেডিট ১৯৯ থেকে কমিয়ে ১৭৯ করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, বর্তমান উপাচার্য চাইছেন দ্রুত নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি চালু করতে, যার কারণে অনেকগুলো অনুষদের শিক্ষাক্রমের খসড়া করা হয়েছে। এতে নতুন কিছু কোর্স যেমন যুক্ত হচ্ছে, তেমনি প্রতিটি অনুষদে আগের চেয়ে মোট ক্রেডিট কমবে।

বিশ্ববিদ্যালয়টির কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন মো. আখতারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, প্রশাসনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকেই প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পড়ানো শুরু করবেন তাঁরা। এ জন্য শিক্ষাক্রম যুগোপযোগী করে শিক্ষা পরিষদে পাসও করিয়েছেন। এই শিক্ষাক্রম অনুযায়ী এক মাসের ইন্টার্নশিপসহ বেশ কয়েকটি নতুন কোর্স যুক্ত করা হয়েছে। উন্নত প্রযুক্তির কৃষিব্যবস্থার কথা বিবেচনা করে নতুন শিক্ষাক্রম তৈরি করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি অনুষদ এখনো শিক্ষা পরিষদে নতুন শিক্ষাক্রম পাস করাতে পারেনি। অথচ জানুয়ারিতে নতুন শিক্ষাবর্ষের ক্লাস শুরু হবে।

অবশ্য উপাচার্য লুৎফুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, তিনি আশা করছেন, আগামী জানুয়ারিতে শুরু হতে যাওয়া শিক্ষাবর্ষেই নতুন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি চালু করা যাবে।

আগামী পর্ব:  জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়