বিচারকদের শাসনকাজে অন্তর্ভুক্ত করা ঠিক নয়

‘নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের এক যুগ’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনায় বক্তারা। জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা, ১৪ ডিসেম্বর। ছবি: সাইফুল ইসলাম
‘নির্বাহী বিভাগ হতে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের এক যুগ’ শীর্ষক মুক্ত আলোচনায় বক্তারা। জাতীয় প্রেসক্লাব, ঢাকা, ১৪ ডিসেম্বর। ছবি: সাইফুল ইসলাম

সুপ্রিম কোর্টের অধীনে একটি সচিবালয় স্থাপন করা উচিত। আর বিচারকদের শাসনকাজে অন্তর্ভুক্ত করা সমীচীন নয়। বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে আইন বা নীতিমালা অনতিবিলম্বে প্রণয়ন করতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিতে আরও উদ্যোগ নিতে হবে। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথক্‌করণের এক যুগ পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত এক মুক্ত আলোচনায় বিশিষ্টজনেরা এসব কথা বলেন।

রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে আজ শনিবার সকালে এক আলোচনায় এসব কথা বলেন বিশিষ্টজনেরা। নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথক্‌করণের এক যুগ পূর্তি উপলক্ষে হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন এই আলোচনার আয়োজন করে। আলোচনা সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ।

আলোচনায় বিচারপতি মো. আবদুল মতিন বলেন, ‘ন্যায়বিচার মানে মনিবের আনুগত্য নয়, বরং আইনের আনুগত্য। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বার এবং বেঞ্চের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনা করা প্রয়োজন। আমাদের চরিত্রে ও অনুভূতিতে স্বাধীনতার বোধ থাকা প্রয়োজন। তাহলেই সত্যিকারে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আসবে।’

বিচারপতি মো. আবদুল মতিন বলেন, ‘আমরা আশাবাদী হব যে বিচার বিভাগ স্বাধীন হবেই। আমরা কাকে খুশি করব, কাকে বিরাগভাজন হব, তা না ভেবে আমরা যদি বলি এখানে আইনের শাসন থাকবে, তাহলে আমাদেরই সজাগ থাকতে হবে, দারোয়ানের মতো কাজ করতে হবে।’

বিচার বিভাগের মধ্যে শাসন বিভাগের কাজ আসা উচিত নয় বলে মনে করেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। তিনি বলেন, সুপ্রিম কোর্টের অধীনে একটি সচিবালয় স্থাপন করা উচিত, যাতে ওভারলেপিং না হয়। আইন মন্ত্রণালয় থেকে ম্যাপ তৈরি করা হয়, সেটা মতামতের জন্য পাঠানো হয়। এই ‘টু অ্যান্ড ফ্লো’ জিনিসটা খুব একটা প্রয়োজনীয় হয় না। এটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে একটা মূল্যবান সময় নেয়।

বিচারকদের শাসনকাজে অন্তর্ভুক্ত করা সমীচীন নয় মন্তব্য করে আলী ইমাম মজুমদার বলেন, বিচার বিভাগ সরাসরি নিয়োগ থেকে শুরু করে অপসারণ করার মতো ক্ষমতা রাখেন। স্বাধীনতার পর থেকে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে অর্জন কম নয়। তবে এই অর্জন যতটা চাই, ততটা হয়নি। অর্জন হয়নি বলে কথা বলতে হবে। ন্যায়বিচার দৃশ্যমান হওয়া উচিত।

বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সহসভাপতি ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন বলেন, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যার মাধ্যমে নিরপেক্ষ, নির্ভরযোগ্য ও আস্থাশীল বিচার পাওয়া যাবে। বিচারকার্য পছন্দ হলে বিচারব্যবস্থা স্বাধীন আর বিচার অপছন্দ হলে বিচারব্যবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ নয়—এটা কিন্তু শোভনীয় না। বিচার বিভাগে নিয়োগ একটি পৃথক খাত হওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করে দেওয়া এখন একটি বৈশ্বিক প্রবণতা তৈরি হয়েছে। বিশ্বে যে যে দেশে কর্তৃত্ববাদী শাসনকাল আসছে, তারা প্রথম টার্গেট করছে বিচার বিভাগকে, কেমন করে বিচার বিভাগকে দুর্বল করা যায়। তিনি আরও বলেন, ‘সর্বাবস্থাতেই বিচারপ্রার্থীরা বিচার পাবেন কি না, আমরা এমন একটা বিচারব্যবস্থা গড়তে পারলাম কি না—এটাই হচ্ছে যাঁরা রাজনীতিতে থাকবেন, তাঁদের সাংবিধানিক কর্তব্য দেখা। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সাধারণ সুশাসনকেই প্রতিনিধিত্ব করে। নির্বাহী বিভাগ দলীয় হলে লেজিসলেশন (আইন বিভাগ) যদি দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে কথা বলতে না পারে, সেখানে বিচার বিভাগ সাংঘাতিক নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ হবে—এটা আমি মনে করি না।’

আলোচনায় মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান। তিনি বলেন, ‘গত এক যুগের অভিজ্ঞতায় এটা পরিষ্কার যে মানসিক জগতে পরিবর্তন আনা এবং অন্তরে পৃথক্‌করণের চেতনা ধারণ করা অনেক বেশি জরুরি। শুধু নির্বাহী বিভাগই পৃথক্‌করণ নিশ্চিত করতে পারবে না।’

মিজানুর রহমান খান আরও বলেন, ‘বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণে আমাদের পলায়নপরতার অবসান ঘটুক। মাসদার হোসেন মামলার অর্জনকে পাথেয় করেই আমাদের পথ চলতে হবে। কিন্তু অধস্তন আদালতের পুরো একটি চ্যাপ্টার সাংবিধানিকভাবে কোমায় আছে কি না, সেটা একটা বড় জিজ্ঞাসা। এমনও হতে পারে, হয়তো অলক্ষ্যে এভাবে পড়ে আছে। কিন্তু এভাবে থাকাটা সমীচীন নয়।’

২০০৭ সালের ১ নভেম্বর নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করা হয়। তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ‘মাসদার হোসেন মামলার রায়ের আলোকে’ এই পৃথক্‌করণ করা হয়।

আলোচনায় সাবেক জেলা জজ মাসদার হোসেন বলেন, বিচার বিভাগ যদি ক্ষমতাসীনদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তার পেটে যদি ক্ষুধা থাকে, বিচার বিভাগকে যদি অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না দেওয়া হয়, তাহলে অন্য স্বাধীনতা মূল্যহীন। বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণের যে ১২ দফা নির্দেশনা ছিল, তার অনেকগুলো কার্যকর করা হয়েছে। কিন্তু কে কার্যকর করছে, ফলাফল কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে, সেটা ভাবতে হবে। তিনি আরও বলেন, বিচারপতিদের মৌলিক অধিকার তখনই হবে, যখন একটা পৃথক বিচার বিভাগে এ দেশে গড়ে উঠবে, যে বিচার বিভাগের নিয়ন্ত্রণ কারও চোখ রাঙানো দ্বারা আক্রান্ত হবে না।

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক এ এম মাহবুব উদ্দিন বলেন, ‘গণতন্ত্র, অর্থনৈতিক মুক্তি, আইনের শাসন—সবকিছুর মূল জায়গা শক্তিশালী বিচার বিভাগ। যে দলই বিরোধী দলে থাকে, সে দল বিচারক নিয়োগের নীতিমালার কথা বলে। কিন্তু বিভিন্ন সরকার থেকে বিধিনিষেধ হওয়া সত্ত্বেও এখন পর্যন্ত আমাদের বিচারক নিয়োগের কোনো আইন ও বিধিমালা নেই। শুনে আশ্চর্য হবেন। বিচারক নিয়োগের আইন বা নীতিমালা অনতিবিলম্বে করতে হবে।’

সভাপতির বক্তব্যে হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ শফিকুর রহমান বলেন, ‘উন্নয়নের জন্য বেশি নিবেদিত—এতটা প্রয়োজন আছে কি না, তা প্রশ্নের দাবি রাখে। উন্নয়নে শরণার্থী যেন আমরা না হয়ে যাই, সেদিকে লক্ষ রাখা বাঞ্ছনীয়। সামনের সময়ে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার সুফল সমাজের সবাই সমানভাবে ভোগ করতে পারবে, এ বিষয়ে আমরা আশাবাদী।’

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজ বলেন, ‘খুব ছোটখাটো এখানে–ওখানে কিছু পরিবর্তন ছাড়া বিচার বিভাগ পৃথক্‌করণে তেমন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। আমরা যখন শুনি, দেশের ৬০ ভাগ এখনো বিচারব্যবস্থার প্রতি আস্থা নেই, তাহলে কেন যাচ্ছে না মানুষ। বিচার পেতে দীর্ঘ সময় লাগছে। এটাও আস্থা আনার বিষয়।’