'অর্থের লোভে পড়ে রোহিঙ্গাদের বিক্রি করছেন সাবাস'

আইসিজেতে মিয়ানমারের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন গণহত্যা বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম সাবাস। ছবি: রয়টার্স
আইসিজেতে মিয়ানমারের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন গণহত্যা বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম সাবাস। ছবি: রয়টার্স

মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলায় আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) দেশটির পক্ষে সাফাই গেয়ে বন্ধু–শত্রু সব মহলের তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ছেন গণহত্যা বিষয়ে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ উইলিয়াম সাবাস। এরপরও তিনি বলেছেন, আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার সবার আছে।

আইসিজেতে গাম্বিয়ার করা মামলায় গত বুধবার ও বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন সাবাস। মিয়ানমারের সেনাদের কর্মকাণ্ডের সাফাই গেয়ে তিনি জোর গলায় দাবি করেন, রাখাইনের রোহিঙ্গারা গণহত্যার শিকার হয়নি। অথচ এই মামলার আগে বিভিন্ন সময় তিনি রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কথা বলেছেন।

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) এশিয়া অঞ্চলের উপপরিচালক ফিল রবার্টস টুইটারে বলেছেন, ‘সাবাস মূলত মিয়ানমারের কিছু অর্থের লোভে রোহিঙ্গাদের বিক্রি করছেন। তাঁর এই আচরণ সম্পূর্ণ অনৈতিক ও দুমুখো।’

সাবাসের এমন অবস্থান নিয়ে সহকর্মীদের মধ্যে যাঁরা তাঁর সমালোচনা করেছেন, তাঁদের একজন যুদ্ধাপরাধবিষয়ক যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক অ্যাম্বাসাডর স্টিফেন র‍্যাপ। বুধবার সন্ধ্যায় দ্য হেগে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘সকালে বন্ধু বিল সাবাসের মুখ থেকে কথা শুনলাম। ১০ দিন আগেও আমি তাঁর সঙ্গে ছিলাম। আমি গণহত্যার মামলা পরিচালনা করেছি। আমরা ওই অপরাধ প্রমাণ করতে পেরেছি। তিনি এখন এ আইন নিয়ে ভুল করছেন। এটা (রোহিঙ্গা হত্যাকাণ্ড) একটি গণহত্যা।’

তবে এমন সমালোচনা নাকচ করে দিয়েছেন কানাডীয় আইন বিশেষজ্ঞ সাবাস। রয়টার্সের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, ‘আমি একজন আন্তর্জাতিক আইনজীবী। আমি আন্তর্জাতিক মামলাগুলো নিয়ে লড়াই করি। এই লড়াইয়ে প্রত্যেকেরই আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার রয়েছে।’

শুনানিতে মানবাধিকার ও আইনের শাসনবিষয়ক পণ্ডিত যুক্তরাজ্যের মিডলসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক সাবাস রাখাইন রাজ্যে হাজারো রোহিঙ্গার প্রাণহানিকে গ্রহণযোগ্যতা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁর নিজের লেখা একটি বইয়ে গণহত্যার বিভিন্ন আলামতের উল্লেখ আছে। আইসিজের শুনানিতে তিনি সেই সব আলামতকেই ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ ও নৃশংসতা’ হিসেবে উল্লেখ করে অপরাধের মাত্রা লঘু করার চেষ্টা করেছেন। এ ছাড়া রোহিঙ্গা হত্যাকাণ্ড গণহত্যার উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়নি বলে দাবি করেন। বলেন, রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে তাড়িয়ে দেওয়াটা বিতাড়ন নয়, বরং অভ্যন্তরীণ সংঘাতের ফলে স্বেচ্ছামূলক গণপলায়ন।

কানাডার এই আইনজীবী রোহিঙ্গাদের ওপর পদ্ধতিগত হামলার বিষয়ে ২০১০ সালে একটি গবেষণামূলক প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন। প্রতিবেদনটিতে এই উপসংহার টানা হয়েছে যে ওই হামলার ক্ষেত্রে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ হয়েছে।

এর তিন বছর পর কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল–জাজিরার এক প্রামাণ্যচিত্রে সাবাসকে বলতে শোনা যায়, রোহিঙ্গাদের ইতিহাস অস্বীকার করা, তারা যেখানে বসবাস করছে সেখানে তাদের থাকার অধিকারের বৈধতা অস্বীকার করা—এসবই বিপৎসংকেত। এসব দেখে ‘গণহত্যা’ শব্দটির কথা মাথায় এলে তা মোটেও অকিঞ্চিতকর হবে না।

যদিও ২০১৩ সালে আল–জাজিরার প্রামাণ্যচিত্র দ্য হিডেন জেনোসাইড–এ নিজের করা মন্তব্য নিয়ে বৃহস্পতিবার আদালতে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন সাবাস। বলেছেন, ওই সময় তিনি মিয়ানমারের প্রকৃত অবস্থা নিয়ে নয়, বরং একটা অনুমাননির্ভর চিত্রের বিষয়েই কথা বলেছিলেন।

তবে আন্তর্জাতিক আইনজীবী সারেটা আশরাফ মনে করেন, মিয়ানমারের গণহত্যা এখনো চলছে। সাবাসের বক্তব্যের বিষয়ে তিনি রয়টার্সকে বলেন, ‘সাবাসের কাছে গণহত্যা মানেই নিহতের সংখ্যার সুনির্দিষ্ট হিসাব–নিকাশ। তাঁর এই যুক্তির সঙ্গে আমি একমত নই। কারণ, এটা শুধু ফালতু যুক্তিতর্কের বিষয় নয়। এর উদ্দেশ্য (রাখাইনে রোহিঙ্গা নিপীড়ন) অবশ্যই গণহত্যা।’