প্রজনন স্বাস্থ্যকে মূলধারায় আনতে হবে

গোলটেবিলে বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা। পাশে এইডস/এসটিডি কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর মো. সামিউল ইসলাম। গতকাল সকালে কারওয়ান বাজারে সিএ ভবনে।  প্রথম আলো
গোলটেবিলে বক্তব্য দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা। পাশে এইডস/এসটিডি কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর মো. সামিউল ইসলাম। গতকাল সকালে কারওয়ান বাজারে সিএ ভবনে। প্রথম আলো

এইচআইভি/এইডসের ব্যাপারে শুরু থেকে গুরুত্ব দেওয়ায় বাংলাদেশে এইচআইভির সংক্রমণ তুলনামূলকভাবে কম। এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য যেমন আছে, ঝুঁকিও আছে। সংক্রমণ আরও কমাতে সরকারি ও বেসরকারি সব কর্মকাণ্ডের সমন্বয় ঘটানো জরুরি হয়ে পড়েছে।

গতকাল শনিবার প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘এইচআইভি প্রতিরোধ কর্মসূচিতে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার প্রয়োজনীয়তা এবং করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অংশগ্রহণকারী বিশেষজ্ঞরা এসব কথা বলেন। প্রথম আলো এই বৈঠকের আয়োজন করে। এই আয়োজনে সহায়তা করে সরকারের জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির নেতৃত্বে সেভ দ্য চিলড্রেন ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল।

গত শতকের আশির দশকে এ দেশে এইডসবিষয়ক কর্মসূচির শুরু ও প্রথম রোগী শনাক্ত করার ইতিহাস তুলে ধরে গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনার সূত্রপাত করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও ভাইরাস বিশেষজ্ঞ নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, শুরু থেকেই গুরুত্ব দেওয়ার কারণে এ দেশে সংক্রমণের হার কম রাখা সম্ভব হয়েছে। এইচআইভি সংক্রমিত ১০৯ জন মায়ের জন্ম দেওয়া নবজাতকের মধ্যে মাত্র দুটির সংক্রমণ ঘটেছে। ১০৭টি নবজাতক সংক্রমণমুক্ত থাকার ঘটনাটি বড় ধরনের সাফল্য।

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের কারিগরি কর্মকর্তা রাহাত আরা নূর বলেন, যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যকে মূলধারার স্বাস্থ্যসেবার সঙ্গে যুক্ত করার বিষয়টি এখন বৈশ্বিক অ্যাজেন্ডা।

বাংলাদেশ সোসাইটি অব মেডিসিনের মহাসচিব অধ্যাপক আহমেদুল কবির বলেন, এইচআইভি যৌনকাজের মাধ্যমে ছড়ায়। যৌনকাজে সক্ষম নারী-পুরুষের মধ্যে এই রোগের সংক্রমণ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এই বয়সী সব মানুষকে সেবার আওতায় আনা কঠিন কাজ।

টাঙ্গাইল যৌনপল্লি ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার সময় যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকারবিষয়ক বিশেষজ্ঞ জুলিয়া আহমেদ বলেন, যৌনপল্লিতে থাকা অনেকের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। অনেকে প্রয়োজনের সময় কনডম পান না।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।

আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় এইডস/এসটিডি কর্মসূচির পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম মিঞা বলেন, রোগ শনাক্তকরণ কেন্দ্রের সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এই কারণে শনাক্তকৃত রোগীর সংখ্যাও বেড়েছে।

এইচআইভি বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের পরামর্শ দেন অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলোজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সভাপতি সামিনা চৌধুরী। তিনি বলেন, গর্ভবতী মায়েদের মধ্যে সংক্রমণ শনাক্ত করতে ওজিএসবির ২ হাজার ১০০ চিকিৎসক বড় ভূমিকা রাখতে পারেন।

পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমান বলেন, শহর এলাকায় এবং মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের মধ্যে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি বাড়াতে হবে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক এস এম শামসুজ্জামান বলেন, এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তি ও এইডসে মৃত্যুর সংখ্যা দুটোই বেড়েছে। কেন বেড়েছে, তা খতিয়ে দেখা দরকার। একই কলেজের চর্মরোগ বিভাগের প্রধান রাশেদ মোহাম্মদ খান বলেন, হাসপাতালে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরীক্ষা বা পরামর্শের সময় গোপনীয়তা রক্ষা করা জরুরি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ন্যাশনাল প্রফেশনাল কর্মকর্তা সাবেরা সুলতানা বলেন, পাঠ্যপুস্তকে এইচআইভি/এইডসের বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকাই যথেষ্ট নয়। সেগুলো ক্লাসে পড়ানো হয় কি না, তার ওপর নজরদারি ও তদারকি থাকা দরকার।

বিএসএমএমইউর ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক মো. আসাদুল ইসলাম বলেন, রক্ত দেওয়ার ব্যাপারে কড়াকড়ি হওয়ার পর দেশে রক্ত বিক্রি কমে গেছে। এটা সংক্রমণ প্রতিরোধে ভূমিকা রেখেছে।

অনুষ্ঠানে যৌনকর্মীদের সমস্যা নিয়ে কথা বলেন সেক্স ওয়ার্কার্স নেটওয়ার্ক অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক আলেয়া আক্তার লিলি। তিনি বলেন, ড্রপ ইন সেন্টারগুলোতে প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা থাকা দরকার।

বিএসএমএমইউর ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, যক্ষ্মা, এইচআইভি, হেপাটাইটিস পরীক্ষা একই যন্ত্র দিয়ে সম্ভব হচ্ছে। তাই এ ক্ষেত্রে কর্মসূচির মধ্যে সমন্বয় বাড়ালে আর্থিক সাশ্রয় হবে।

জাতিসংঘের এইডসবিষয়ক সংস্থা ইউএন এইডসের এ দেশীয় ব্যবস্থাপক সায়মা খান বলেন, নারী যৌনকর্মীরা বহু ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়। সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রেও তারা বৈষম্যের শিকার হয়। তিনি বলেন, সেবার ক্ষেত্রে বৈষম্য হলে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জন দুরূহ হবে।