রুম নম্বর ২২৭, জ্জোহা হল

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলে এখনো আছে ২২৭ নম্বর কক্ষটি। গতকাল দুপুরে।  ছবি: প্রথম আলো
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হলে এখনো আছে ২২৭ নম্বর কক্ষটি। গতকাল দুপুরে। ছবি: প্রথম আলো

১৯৭১, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ শামসুজ্জোহা হল কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, পাকিস্তান সেনাবাহিনী।

ক্যাম্পের রুম নম্বর ২২৭। এক আসনের কক্ষে বন্দী ১৩ থেকে ১৫ জন। কোনো এক রাতে তালিকা ধরে বন্দীদের নাম ডাকল পাকিস্তানি সেনারা। একে একে তাঁরা বের হলেন। যাঁদের নিয়ে যাওয়া হলো সকালে, তাঁরা আর ফিরলেন না। রাতের আঁধারে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হলো ক্যাম্পের পাশের গণকবরে। পরদিন কক্ষে এলেন নতুন বন্দী। এবার হয়তো তাঁদের মৃত্যুর পালা।

এই বর্ণনা মুক্তিযুদ্ধের সময় ওই কক্ষেই প্রায় চার মাস বন্দী থাকা লিয়াকত আলীর। তিনি এখন ওয়ার্কার্স পার্টির রাজশাহী মহানগরের সভাপতি। ১৯৭১–এর আগস্টের মাঝামাঝি সময় থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্তবন্দী থাকার পরও ভাগ্যক্রমে বেঁচে ফিরেছিলেন ক্যাম্প থেকে। তবে বন্দিদশায় সাক্ষী হয়েছিলেন যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি ক্যাম্পে হওয়া নানা কর্মকাণ্ডের। ২২৭ নম্বর কক্ষ থেকে একদিন ডাকা হয়েছিল লিয়াকত আলীকেও। তবে সেদিনের বর্ণনার আগে তিনি বললেন, ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্টের একবিকেলের কথা।

লিয়াকত আলীর বাড়ি রাজশাহী নগরের গোড়ামারা মহল্লায়। বাবার নাম ইনসান আলী। যুদ্ধের সময় লিয়াকতের বয়স ছিল ১৩ বছর। বড় ভাই কাসেম আলী জড়িত ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে। তাঁর সম্পর্কে তথ্য নিতেই ১৫ আগস্ট বিকেলে বাড়িতে পুলিশ আসে। ধরে নিয়ে যায় লিয়াকতকে।

স্মৃতিচারণা করে গতকাল রোববার লিয়াকত আলী বলছিলেন, ‘থানায় গিয়ে দেখি আরও চার, পাঁচজনকে আনা হয়েছে। থানা থেকে সবাইকে একটা জিপে করে নেওয়া হলো জোহা হলের গেস্টরুমে। সেখানে বড় ভাই কাসেম আলীর অবস্থান সম্পর্কে জানার জন্য চলল জিজ্ঞাসাবাদ। কিন্তু আমি কিছু না জানার ভান করে থাকি। এরপর সবাইকে নেওয়া হলো হলের সেই ২২৭ নম্বর কক্ষে। বন্দিসংখ্যা প্রায় ১২ থেকে ১৩ জন। এর মধ্যে ছিলেন জননেতা আতাউর রহমানও।

হলের নিচতলাকে গোলাবারুদ রাখার স্থান হিসেবে ব্যবহার করত পাকিস্তানি সেনারা। এগুলো ঢেকে রাখা হতো। এ জন্য বন্দীদের প্রতিদিন মাটি কাটার কাজ করতে হতো। বস্তায় ভরে মাটি নিয়ে এসে গোলাবারুদ আড়াল করা হতো। লিয়াকত আলী বলছিলেন, ২২৭ নম্বর কক্ষের জীবন ছিল বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষের হাতে আটক হওয়া বন্দীদের মতো। দিনভর ক্যাম্পের বিভিন্ন কাজ করে নেওয়া হতো। বিপরীতে এক বেলা খাবারও জুটত না। একদিন মাটি কেটে ডাইনিং হলের ভেতর দিয়ে আসার সময় দেখেন, আর্মিরা বসে রুটি খাচ্ছে। রুটির কিছু অংশ আবার ফেলে দিচ্ছে টেবিলের নিচে। সেনারা খাওয়া সেরে উঠে গেলে রুটির টুকরা কুড়িয়ে লুঙ্গিতে গুঁজে নিতেন বন্দীরা। রাতের বেলায় শুধু একবার করে চাল ও খেসারির ডাল সেদ্ধ খেতে দেওয়া হতো।

২২৭ নম্বর কক্ষে লিয়াকত আলী তখন বেশ কিছুদিন কাটিয়ে ফেলেছেন। একদিন রাতে হঠাৎ করেই কক্ষে আরেকজনকে নিয়ে আসা হলো। সারা শরীরে সিগারেটের আগুনের ছেঁকা দেওয়া। যন্ত্রণায় যেন তাঁর চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম। আরেক দিন নিয়ে আসা হয় এক মুক্তিযোদ্ধাকে। তাঁর সঙ্গীরা মারা গেছেন। ধরা পড়েছেন তিনি একা। পেটে বেয়োনেট দিয়ে খোঁচানো হয়েছে।

১৬ ডিসেম্বর রাতে ২২৭ নম্বর কক্ষ থেকে ডাকা হলো লিয়াকত আলীসহ ১৩ জন বন্দীকে। দাঁড় করানো হলো হলগেটের সামনে। সেই মুহূর্তের স্মৃতিচারণা করে লিয়াকত আলী বলছিলেন, ‘তখন মনে হয়েছিল সেদিনই জীবনের শেষ রাত। কিন্তু যা ভেবেছিলাম, তা হলো না। করমর্দন করল পাকিস্তানি সেনারা। সবার উদ্দেশে বলা হলো, “আমাদের ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দিয়েন। আপনারা চলে যান।” এর আগে বন্দীদের দিয়ে নিজেদের মালামাল ট্রাকে উঠিয়ে নেয় সেনারা। তখন হলের বিভিন্ন কক্ষ থেকে মালামাল আনতে গিয়ে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখি নারীদের চুলের গোছা, ব্লাউজ, শাড়ির ছেঁড়া টুকরা। তখন মনে হলো, দেশটা এমনি এমনি স্বাধীন হয়নি।’

১৯৭৮ সালে ২২৭ নম্বর কক্ষে আবার গিয়েছিলেন লিয়াকত আলী। বন্দী হয়ে নন, স্বাধীন বাংলাদেশের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্র হয়ে।