'আলমগীর কোথায়?'

স্বামী এ টি এম আলমগীরের ছবি হাতে স্ত্রী নাদিরা আলমগীর। ছবি: আবদুস সালাম
স্বামী এ টি এম আলমগীরের ছবি হাতে স্ত্রী নাদিরা আলমগীর। ছবি: আবদুস সালাম

‘আলমগীর কোথায়?’—১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি প্রশ্নটি করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিন সকালবেলা জাতির জনকের সঙ্গে তাঁর বাসভবনে দেখা করতে যান মুক্তিযুদ্ধফেরত বাঙালি দুই বৈমানিক ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার ও ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দীন আহমেদ। তরুণ এই দুই বৈমানিককে দেখার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমেই প্রশ্নটি করেন বঙ্গবন্ধু। ৪৭ বছর আগে বঙ্গবন্ধুর সেই প্রশ্নের উত্তর ২০১৯ সালে এসেও অজানাই রয়েছে। প্রশ্নটির উত্তর এখনো খুঁজে ফিরছেন বর্তমানে ৮১ বছর বয়সী আলমগীর সাত্তার ও ৭১ বছরের সাহাবুদ্দীন আহমেদ। নিখোঁজ আলমগীরের পরিবারের সদস্যরা দুটি শব্দের একটি প্রশ্নের উত্তর জানেন না। তাঁরা শুধু বলেন, হয়তো তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।

কে এই আলমগীর?
পুরান ঢাকার সম্ভ্রান্ত এক পরিবারে ১৯৪৩ সালের ৭ মার্চ জন্ম আলমগীরের। পুরো নাম আবু তারেক মোহাম্মদ আলমগীর, সংক্ষেপে এ টি এম আলমগীর। সবাই ডাকতেন ‘আলমগীর’। তাঁর বাবা এ আর শাহজাহান ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ছিলেন। পুরান ঢাকার ২৫ জিন্দাবাহার লেনে কয়েক বিঘা জায়গার ওপর ছিল তাঁর বাড়ি।

পাইলট এ টি এম আলমগীরের নেতৃত্বগুণের কারণে বঙ্গবন্ধু তাঁকে পছন্দ করতেন।

অন্যায়ের প্রতিবাদ
এ আর শাহজাহানের তিন সন্তানের মধ্যে আলমগীর ছিলেন একমাত্র ছেলে। ছোটবেলা থেকে বেশ জেদি আলমগীর। চোখের সামনে অন্যায় কিছু ঘটলে প্রতিবাদ করতেন। স্কুল-কলেজে পড়াশোনার পর্ব শেষ করে ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে বৈমানিক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু বিমানবাহিনীতে অন্যায় আচরণের শিকার হতেন বাঙালি কর্মকর্তারা। এ নিয়ে প্রায়ই তর্কে জড়িয়ে যেতেন আলমগীর। প্রতিবাদ করতেন। মতভেদের কারণে তাঁকে বিমানবাহিনী থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। মেধাবী আলমগীর দমে যাননি। বাণিজ্যিক উড়োজাহাজের পাইলটের লাইসেন্স নিয়ে এরপর পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনসে (পিআইএ) যোগ দেন।

পিআইএ যোগ দেওয়ার পরও বৈষম্য দেখতে পান এ টি এম আলমগীর। তিনি দেখতে পান, পিআইএর ৩৫০ জন পাইলটের মধ্যে মাত্র ৩০ জন বাঙালি। পদোন্নতি দেওয়ার সময় গড়িমসি বা অজুহাত দেখত পিআইএ কর্তৃপক্ষ। পদোন্নতির সময় হলে ফ্লাইং ক্লাবের ইনস্ট্রাক্টর দিয়ে ফেল করানো হতো। সনদ থাকলেও পিআইএতে বাঙালি পাইলটদের চাকরি দেওয়া হতো কম। তখনই এ টি এম আলমগীর পিআইএর বাঙালি পাইলটদের সম-অধিকার আদায়ে সোচ্চার হন। পিআইএতে যোগ দেওয়ার পর বিয়ে করেন তিনি। স্ত্রী নাদিরা আলমগীরকে নিয়ে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে স্যার সৈয়দ ইকবাল রোডে বাসা ভাড়া করেন। সেই বাড়ির চিলেকোঠায় পিআইএর বাঙালি পাইলটদের নিয়ে আড্ডা দিতেন। আড্ডার আড়ালে উড়োজাহাজ চালানোর কারিগরি দিক নিয়ে বেশি আলোচনা করতেন। তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ক্যাপ্টেন আলমগীর বারবার একটি কথাই বলতেন, পশ্চিম পাকিস্তানি পাইলটদের তুলনায় বাঙালি পাইলটেরা তুলনামূলকভাবে চৌকস, ফ্লাইংয়ে দক্ষ। কিন্তু বাঙালিদের দমিয়ে রাখা হচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানে পাঁচটি ফ্লাইং ক্লাব রয়েছে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে রয়েছে মাত্র একটি ফ্লাইং ক্লাব। তা ছাড়া এখানে ৪০ আসনের তিনটি এফ-২৭ ও ২০ আসনের দুটি ওটার উড়োজাহাজ যাত্রী পরিবহনের জন্য রাখা হতো। অন্যদিকে, করাচি ছিল পুরো পাকিস্তানের বিমান চলাচলের হাব। সেখানে সাতটি বোয়িং ৭০৭ ও আটটি ফকার রাখা হতো। আন্তর্জাতিক রুটের অধিকাংশ ফ্লাইট করাচিকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হতো।

স্বামী আলমগীর বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন, মারা গেলে লাশটি কোথায় আছে, তাও অজানা নাদিরার কাছে। ছবি: প্রথম আলো
স্বামী আলমগীর বেঁচে আছেন, নাকি মারা গেছেন, মারা গেলে লাশটি কোথায় আছে, তাও অজানা নাদিরার কাছে। ছবি: প্রথম আলো

এসব ক্ষোভ থেকে ৮-১০ জন বাঙালি পাইলট অন্য বাঙালি পাইলটদের নিয়ে ইস্ট পাকিস্তান এয়ারলাইনস পাইলটস অ্যাসোসিয়েশন (ইপাআলপা) গঠনের চিন্তা করেন। এ জন্য তেজগাঁও এলাকায় একটি অফিস ভাড়া করা হয়।

এর আগে থেকেই এ টি এম আলমগীরসহ পাইলট আমিরুল ইসলাম, আলমগীর সাত্তার, সাহাবুদ্দীন আহমেদ, সরফুদ্দীন আহমেদ, আকরাম হোসেনেরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। তবে এ টি এম আলমগীরের নেতৃত্ব দারুণ পছন্দ করতেন বঙ্গবন্ধু। পাকিস্তান সরকারের বাধার পর হাইকোর্টের রায়ে ১৯৭০ সালে প্রথম দিকে ইপাআলপা রেজিস্ট্রেশন পায়। প্রথমে এর সদস্য ছিলেন বাঙালি ২৫ জন পাইলট।

পাকিস্তান সরকারের টার্গেট আলমগীর
ইপাআলপা প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাকিস্তানি সরকার কড়া নজরদারিতে রাখে বাঙালি পাইলটদের। তাঁদের মধ্যে প্রধান টার্গেট ছিলেন ক্যাপ্টেন এ টি এম আলমগীর। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর ইয়াহিয়া খান উড়োজাহাজে করে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে যান। তাঁকে বহনকারী উড়োজাহাজের পাইলট ছিলেন ক্যাপ্টেন এ টি এম আলমগীর, সেকান্দার আলী, ক্যাপ্টেন আলমগীর সাত্তার। কিন্তু নির্দেশ অনুযায়ী ছয় হাজার ফুট ওপর দিয়ে ইয়াহিয়া খান ও তাঁর সঙ্গীদের বহনকারী উড়োজাহাজ উপদ্রুত এলাকার ওপর দিয়ে উড়ে যায়। ঢাকায় ফেরার পর ব্রিফিংয়ে এ কথা জানিয়ে দেন এ টি এম আলমগীর। এতে আরও ক্ষিপ্ত হয় পাকিস্তান সরকার।

১৯৭১ সালের মার্চ থেকে পাইলটদের আটক
১৯৭১ সালের উত্তাল মার্চের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় এসে এফ-২৭ উড়োজাহাজে করে পাকিস্তানি সেনা অফিসারেরা দেশের বিভিন্ন স্থানে চলে যান। এ তথ্য এ টি এম আলমগীরসহ বেশ কজন বাঙালি পাইলট বঙ্গবন্ধুকে জানিয়ে দেন। তখন থেকে বাঙালি পাইলটদের ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ করে দেয় পিআইএ। কেবল নজরদারির জন্য মতিঝিলে পিআইএ কার্যালয়ে হাজিরা খাতায় সই করা বাধ্যতামূলক করা হয়। ২৭ মার্চ ক্যাপ্টেন এ টি এম আলমগীর, ক্যাপ্টেন রাফিউল হক, ক্যাপ্টেন জহিরুল হক, ক্যাপ্টেন মফিদুল ইসলামরা ভারতের দিকে রওনা দেন। কিন্তু পাবনা পর্যন্ত যাওয়ার পর ক্যাপ্টেন আলমগীরের প্রচণ্ড জ্বর হয়। তিন থেকে চার দিন পর ঢাকায় এসে পুরান ঢাকা থেকে স্ত্রী ও দুই সন্তানকে নিয়ে ভারতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি। কিন্তু টাকা–পয়সার জোগাড় করতে না পেরে দেরি হয়। এর মধ্যে ৬ এপ্রিল থেকে তিন পাইলট ক্যাপ্টেন আমিরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এন এস হায়দার ও পিআইএর উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হকের হদিস পাওয়া যাচ্ছিল না। ভারতে যাওয়ার আগে ২৩ এপ্রিল মতিঝিল এলাকা থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন আরিফের নেতৃত্বে এ টি এম আলমগীরকে তুলে নেওয়া হয়। তখন থেকে তাঁর কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি। একইভাবে ক্যাপ্টেন আমিরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এন এস হায়দার ও পিআইএর উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলুল হকের কোনো সন্ধান মেলেনি।

পাইলট এ টি এম আলমগীর।
পাইলট এ টি এম আলমগীর।

ক্যাপ্টেন এ টি এম আলমগীরের স্ত্রী নাদিরা আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘সকাল সাড়ে নয়টার দিকে জিন্দাবাহার লেনে আমার শ্বশুরবাড়ি থেকে বের হন আলমগীর। যাওয়ার সময় মনেও হয়নি এটিই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ দেখা, আর কখনো দেখা হবে না।’

কোথায় এটি এম আলমগীরকে নেওয়া হয়েছিল? এর উত্তরে ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দীন আহমেদ ও আলমগীর সাত্তার জানান, ধারণা করা হয়, তেজগাঁওয়ে পুরোনো বিমানবন্দরে নেওয়ার পথে এ টি এম আলমগীরকে গুলি করা হয়। সে সময় বিমানবন্দরের দক্ষিণ দিকে জঙ্গলে তাঁর মরদেহ পুঁতে ফেলে হয়। একইভাবে আমিরুল ইসলাম, এন এস হায়দার ও ফজলুল হকের মরদেহ গুম করা হয়। দেশ স্বাধীনের পর বিমানবন্দর এলাকায় বহুবার তন্ন তন্ন করে লাশের সন্ধান করা হয়। কিন্তু মেলেনি।

যুদ্ধ শেষে দুই সন্তানকে নিয়ে ভীষণ বিপদে পড়েন ক্যাপ্টেন আলমগীরের স্ত্রী নাদিরা আলমগীর। কারণ, মেয়ে রুনা আলমগীরের বয়স তখন দুই বছর, আর ছেলে তারেক আলমগীর তখন মাত্র এক বছর। পরে সিনিয়র সেলস এক্সিকিউটিভ হিসেবে বাংলাদেশ বিমানে চাকরি করেন তিনি। নিজের আয়ে সংসার চালিয়েছেন। তাঁর ছেলে তারেক আলমগীর রাশিয়ায় পড়াশোনা করে প্রকৌশলী হয়ে এখন বিমানের ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত। অন্যদিকে, মেয়ে রুনা আলমগীর নেদারল্যান্ডসপ্রবাসী। জীবনযুদ্ধে সফলতা পেলেও উত্তর হয়তো মিলবে না—‘আলমগীর কোথায়?’

ছেলে তারেক আলমগীর বলেন, ‘বাবার কোনো স্মৃতি আমার কাছে নেই। মা–ই আমাদের অনেক কষ্টে মানুষ করেছেন। মায়ের কাছ থেকেই বাবার অনেক কথা শুনেছি।’