পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মিত্রবাহিনীর কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করে। তাদের এ আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ২৬ মার্চ শুরু হওয়া মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তি ঘটে।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার জন্য চূড়ান্ত যুদ্ধে অংশ নিতে ধাপে ধাপে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলেন। একাত্তরের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার সামনে দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণে শত্রুদের মোকাবিলা করার জন্য যার যা আছে, তা-ই নিয়ে সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তাঁর এই ভাষণের পর সারা দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ওই রাতেই গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ।

১৭ এপ্রিল শপথ নেয় মুজিবনগর সরকার। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে এই সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী হন তাজউদ্দীন আহমদ। এই সরকারের নেতৃত্বে পরিচালিত হয় মুক্তিযুদ্ধ।

৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের শেষ ভাগে ৩ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের চারদিক থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ওপর সাঁড়াশি আক্রমণ শুরু করে। মিত্রবাহিনীর তীব্র আক্রমণের মুখে তারা টিকতে না পেরে পিছু হটে গিয়ে বড় শহরগুলোতে সমবেত হতে থাকে। একই সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া পাকিস্তানি সেনাদের ছোট ছোট দল মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে থাকে।

পরাজয় অনিবার্য দেখে ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার জেনারেল এ এ কে নিয়াজিকে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের জীবন রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। সে দিন বিকেলেই নিয়াজি যুক্তরাষ্ট্রের মাধ্যমে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাঠান। ১৫ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে অস্ত্র সংবরণ করে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান জেনারেল হামিদ এ প্রস্তাবে সম্মত হওয়ার জন্য নিয়াজিকে সংকেত দেন। মানেকশ নিয়াজিকে প্রস্তাব গ্রহণ ও কার্যকর করার জন্য ১৫ ডিসেম্বর বিকেল পাঁচটা থেকে পরদিন সকাল নয়টা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন। পরে এই মেয়াদ বেলা তিনটা পর্যন্ত বাড়ানো হয়।

১৬ ডিসেম্বর সকাল সোয়া নয়টার সময় মানেকশ ভারতের পূর্বাঞ্চল বাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ মেজর জেনারেল জে এফ আর জেকবকে আত্মসমর্পণের দলিল ও আনুষ্ঠানিকতা চূড়ান্ত করার জন্য ঢাকায় পাঠান। ঢাকায় আলোচনাকালে নিয়াজি দলিলে ‘আত্মসমর্পণ’ শব্দটির জায়গায় ‘যুদ্ধবিরতি’ লেখার প্রস্তাব দিলে জেকব তা বাতিল করে দেন। এরই মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী মানসিকভাবে পরাজয় স্বীকার করে নিয়েছিল। আত্মসমর্পণের দলিলসহ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন বিষয়ে নিয়াজির সম্মতি পেতে জেকবকে তাই বিশেষ বেগ পেতে হয়নি।

অবশেষে মুক্তিযুদ্ধের জয়ী ও পরাজিত দুই পক্ষের মধ্যে ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের ঐতিহাসিক দলিল স্বাক্ষরিত হয়। দেশের অন্যান্য জায়গায় স্থানীয়ভাবে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত আত্মসমর্পণের দলিল স্বাক্ষরিত হতে থাকে।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় স্বাক্ষরিত দলিলের বাংলা ভাষ্য নিচে দেওয়া হলো:

আত্মসমর্পণের দলিল, ঢাকা ১৬৩১ ঘণ্টা (আইএসটি), ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সকল সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণে সম্মত হলো। পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীসহ সব আধা সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে এই আত্মসমর্পণ প্রযোজ্য হবে। এই বাহিনীগুলো যে যেখানে আছে, সেখান থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃত্বাধীন সবচেয়ে নিকটস্থ নিয়মিত সেনাদের কাছে অস্ত্র সমর্পণ ও আত্মসমর্পণ করবে।

এই দলিল স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীন হবে। নির্দেশ না মানলে তা আত্মসমর্পণের শর্তের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে যুদ্ধের স্বীকৃত আইন ও রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলির অর্থ অথবা ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো সংশয় দেখা দিলে, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত।

লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পণকারী সেনাদের জেনেভা কনভেনশনের বিধি অনুযায়ী প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান দেওয়ার নিশ্চয়তা দিচ্ছেন এবং আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সামরিক ও আধা সামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও সুবিধার অঙ্গীকার করছেন। লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীন বাহিনীগুলোর মাধ্যমে বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও জন্মসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যক্তিদের সুরক্ষাও দেওয়া হবে।

জগজিৎ সিং অরোরা
লেফটেন্যান্ট জেনারেল
জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ
পূর্ব রণাঙ্গনে ভারত ও বাংলাদেশ যৌথ বাহিনী
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১

আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজি
লেফটেন্যান্ট জেনারেল
প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, অঞ্চল বি
এবং পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের (পাকিস্তান) অধিনায়ক
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১