ছেলের সঙ্গে শেষ কথা হলো না মায়ের

আগুনে দগ্ধ মোস্তাকিন মারা যান সকালে। ছেলের লাশ নিতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা রোকেয়া বেগম। ছেলের সঙ্গে শেষবারের মতো কথা বলার সুযোগটুকুও হয়নি তাঁর। গতকাল ঢাকা মেডিকেলের মর্গে।  ছবি: প্রথম আলো
আগুনে দগ্ধ মোস্তাকিন মারা যান সকালে। ছেলের লাশ নিতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন মা রোকেয়া বেগম। ছেলের সঙ্গে শেষবারের মতো কথা বলার সুযোগটুকুও হয়নি তাঁর। গতকাল ঢাকা মেডিকেলের মর্গে। ছবি: প্রথম আলো

ছেলে আগুনে দগ্ধ হওয়ার দুই দিন পর সেই খবর পান মা রোকেয়া বেগম। গত শুক্রবার সকালে খবরটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে রাজশাহীর গোদাগাড়ী থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন তিনি। সেদিন বিকেলে ঢাকায় পৌঁছার পর থেকেই ছেলের সঙ্গে একটু কথা বলার অপেক্ষায় ছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর ছেলে মোস্তাকিনকে কৃত্রিম শ্বাস–প্রশ্বাস দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। ছেলের সঙ্গে আর কথা বলার সুযোগ হলো না রোকেয়া বেগমের। গতকাল রোববার সকালে না ফেরার দেশে চলে গেছেন মোস্তাকিন।

শুধু মোস্তাকিন একা নন; কেরানীগঞ্জে প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরির কারখানায় আগুনে দগ্ধ আরও চার কর্মী গতকাল মারা গেছেন। এ নিয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মোট ১৯ জনের মৃত্যু হলো। এর মধ্যে চারজন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল মারা যান। তাঁরা হলেন মোস্তাকিন (২২), আবদুর রাজ্জাক (৪০), আবু সাইদ (১৭) ও সুমন (২২)। এ ছাড়া বিকেলে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়ার বাড়িতে মারা যান দুর্জয় দাস (১৮) নামের আরেক কর্মী।

মোস্তাকিন মায়ের একমাত্র ছেলে। তাঁর বাবা কয়েক বছর আগে মারা গেছেন। তাঁর দুই বোনের বিয়ে হয়েছে। ঢাকায় কাজ করতে আসার পর থেকে তাঁর আয়ের ওপরেই নির্ভরশীল ছিলেন মা রোকেয়া বেগম। গতকাল দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গের সামনে বিড় বিড় করে তিনি বলেন, ‘দুই দিন বেটা আমার মা মা বুলে ড্যাকেছে। হামাক কাছে পায় নাই। যখন অ্যাসেছি, তখন আর কিছু ব্যুইলবার পারে না।’

চিকিৎসকেরা জানান, দগ্ধ হওয়ার পর প্রথম দুই দিন মোস্তাকিনের কিছুটা জ্ঞান ছিল। তখন তিনি মাকে খুঁজেছিলেন।

গত বুধবার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকার প্রাইম পেট অ্যান্ড প্লাস্টিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ঘটনাস্থলেই পুড়ে মারা যান এক শ্রমিক। পরদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে আরও ১২ জনের মৃত্যু হয়। শ্বাসনালি পুড়ে যাওয়া ১০ কর্মীকে রাখা হয় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে। সেখানে শনিবার সকালে ১৪ বছর বয়সী কিশোর আসাদ মারা যায়।

গতকাল দুপুরে বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের জাতীয় সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘এই মুহূর্তে ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে দগ্ধ আরও ছয়জন চিকিৎসাধীন (সন্ধ্যায় সুমন নামের একজন মারা গেছেন) আছেন। এঁদের প্রত্যকের শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। কারও অবস্থাই ভালো নয়।’ এ ছাড়া এই অগ্নিকাণ্ডে আহত আরও আটজন বর্তমানে ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের হাই ডিপেন্ডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) চিকিৎসাধীন। তাঁদের অবস্থা তুলনামূলক ভালো বলে জানান সামন্ত লাল সেন।

গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে মারা যান কারখানার কর্মী আবদুর রাজ্জাক। তাঁর স্ত্রী গুলশান আরাকে স্বামীর মৃত্যুর খবর জানানো হলে তিনি আইসিইউর সামনে বসে পড়েন। আগুনে রাজ্জাকের শরীরের শতভাগ পুড়ে গিয়েছিল। পরে হাতের কাটা আঙুল দেখে গুলশান আরা তাঁকে চিহ্নিত করেছিলেন। এই অগ্নিকাণ্ডে রাজ্জাকের ভাই আলমও মারা যান তিন দিন আগে। এই নারী বলেন, ‘সকাল-বিকাল মাইয়া বাপরে খোঁজে। বলে আব্বু কখন আইব। মাইয়ারে আমি এখন কী বুঝ দিমু। একলা কেমনে মানুষ করব তারে?’

দুপুর পৌনে ১২টায় মৃত ঘোষণা করা আবু সাইদ ছিলেন পরিবারের একমাত্র ছেলে। মর্গের সামনে বিষাদগ্রস্ত বাবা শামীম দেওয়ান কথা বলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। চাচা মো. জসীম জানান, মাত্র দুই মাস আগে বিক্রমপুর থেকে এসে কারখানার কাজে যোগ দিয়েছিলেন সাইদ।

এদিকে সন্ধ্যায় কেরানীগঞ্জের বাড়িতে থাকা দুর্জয় দাসের (১৮) মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। আগুনে শ্বাসনালির সঙ্গে দুর্জয়ের শরীরের ৯০ শতাংশই পুড়ে গিয়েছিল। অগ্নিকাণ্ডের পর তাঁকেও আনা হয়েছিল ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে। ছেলেকে বাঁচানো যাবে না, এটি বুঝতে পেরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বেশ ঝামেলা করেই বাবা মিন্টু দাস দুর্জয়কে বাড়িতে নিয়ে যান। গতকাল সন্ধ্যায় মিন্টু দাস বলেন, ‘মেডিকেল থেকে আমারে ফোন করছিল ক্ষতিপূরণের ট্যাকা নেওয়ার জন্য। সেই টাকা নিয়ে বাড়িতে ফেরার পথে খবর পাই, পোলায় আর নাই।’

গতকাল দুপুরে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে দগ্ধদের দেখতে যান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আহতদের চিকিৎসার বিষয়টি সরকার সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। যত দিন প্রয়োজন, তত দিন পর্যন্ত সরকার চিকিৎসার সব খরচ বহন করবে।