৪৪ বছর পর সম্মাননা পেলেন তিন বন্ধু

৪৪ বছর পর তিন বন্ধুকে সম্মাননা জানিয়েছে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলা প্রশাসন। ছবি: আনিসুর রহমান
৪৪ বছর পর তিন বন্ধুকে সম্মাননা জানিয়েছে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলা প্রশাসন। ছবি: আনিসুর রহমান

প্রবীর বর্মন, নির্মল কর্মকার ও অশোক পাল। তিন বন্ধু। একই সঙ্গে কলেজে পড়েছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এলাকায় প্রথম প্রতিবাদ করেছিলেন তাঁরা। পুলিশি নির্যাতন সহ্য করে ২৯ মাস কারাভোগও করতে হয়েছে। কিন্তু এই আত্মত্যাগের কোনো স্বীকৃতি এত দিন পাননি তাঁরা। অবশেষে ৪৪ বছর পর উপজেলা প্রশাসনের তরফ থেকে মিলল সম্মাননা।

মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে ‘সম্মাননা স্মারক’ হাতে তুলে দিয়ে এই তিন বন্ধুর আত্মত্যাগের প্রাথমিক স্বীকৃতি দিয়েছে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলা প্রশাসন। উপজেলার গুরুদাসপুর পৌরসভার চাঁচকৈড় বাজার এলাকাতেই থাকেন তিন বন্ধু।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর কীভাবে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিলেন তাঁরা? সেই কথাই শোনালেন তিন বন্ধু। ১৯৭৫ সালে তিন বন্ধুই বিলচলন শহীদ সামসুজ্জোহা কলেজের উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন। ১৫ আগস্ট বেতারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে হতবিহ্বল হয়ে পড়েন তাঁরা। ভয়ে এলাকার সবাই চুপ করে ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার দাবি করে তিন বন্ধু দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগিয়ে দেন। পরদিন কলেজের সহপাঠীদের নিয়ে প্রতিবাদ মিছিলও বের করেন। এদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে নেতৃত্ব দেওয়ায় তিন বন্ধুকে খুঁজছিল পুলিশ। গ্রেপ্তার করার জন্য হানা দেয় তাঁদের বাড়িতে। পরিস্থিতি বুঝে তিন মাসের জন্য আত্মগোপনে চলে যান তাঁরা। ৩রা নভেম্বর জেলখানায় জাতীয় চার নেতা হত্যার পর আবার প্রকাশ্যে আসেন তাঁরা, গর্জে ওঠে তাঁদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। তিন দিন পর ৬ নভেম্বর পুলিশের হাতে আটক হন তিন বন্ধু। স্বজনদের সামনেই অমানুষিক নির্যাতন করা হয় তাঁদের। থানায় নিয়ে নানা কায়দায় শারীরিক নির্যাতন করা হয়। পরদিন নেওয়া হয় নাটোর জেলহাজতে। সেখানে ১৫ দিন রাখার পর পাঠানো হয় রাজশাহী জেলহাজতে। তিন মাস পর পরীক্ষার জন্য অশোক পালকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দেন আদালত। কিন্তু পরীক্ষার দিন কেন্দ্র থেকেই তাঁকে আবার আটক করে পুলিশ। জামিন না পাওয়ায় পরীক্ষা দিতে পারেননি প্রবীর বর্মন ও নির্মল কর্মকার।

তিন বন্ধুর হাতে সম্মাননা তুলে দেয় গুরুদাসপুর উপজেলা প্রশাসন। ছবি: আনিসুর রহমান
তিন বন্ধুর হাতে সম্মাননা তুলে দেয় গুরুদাসপুর উপজেলা প্রশাসন। ছবি: আনিসুর রহমান

প্রবীর বর্মন ও নির্মল কর্মকার জানালেন, রাজশাহী জেলখানায় বিচারবহির্ভূতভাবে দুই বছর আটকে রাখা হয় তাঁদের। দুই বছরের মাথায় রাজশাহী জেলা জজ আদালতে ছয় মাসের সশ্রম কারাদণ্ড হয় তাঁদের। একই সঙ্গে ২০০ টাকা জরিমানা ও অনাদায়ে দুই মাসের জেল দেওয়া হয়। জমি-গরু বিক্রি করে জরিমানার টাকা পরিশোধ করেছিলেন তাঁরা।

দেরিতে হলেও সম্মাননা পেয়ে খুশি অশোক পাল। আনন্দের অশ্রু নিয়ে বললেন, ‘জমিজমা নেই। গান শিখিয়ে আয়ের টাকায় সংসার চালাই। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে ম্যানেজমেন্টে অনার্স (সম্মান) শেষ করেছে। এখন তার চাকরি হলেই আমি খুশি।’ প্রবীর বর্মন ও নির্মল কর্মকারও নিজেদের সন্তানের চাকরির আশায় আছেন।

গুরুদাসপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তমাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন বন্ধুর দেশপ্রেম আমাদের আবেগতাড়িত করেছে। প্রাথমিকভাবে বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে তাঁদের সম্মাননা জানানো হয়েছে। ভবিষ্যতে বিষয়টি বড় করে দেখা হবে।’