আন্দোলন হয়, হল উদ্ধার হয় না

পুরান ঢাকার মালিটোলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখল হওয়া বজলুর রহমান হলের জমিতে শহীদ জিয়াউর রহমান উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে সিটি করপোরেশন। গতকাল বিদ্যালয়টির প্রধান ফটকে বজলুর রহমান হলের ব্যানার টাঙিয়ে দেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা । প্রথম আলো
পুরান ঢাকার মালিটোলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখল হওয়া বজলুর রহমান হলের জমিতে শহীদ জিয়াউর রহমান উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে সিটি করপোরেশন। গতকাল বিদ্যালয়টির প্রধান ফটকে বজলুর রহমান হলের ব্যানার টাঙিয়ে দেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা । প্রথম আলো

দীর্ঘদিন বেদখলে থাকা ১১টি হলের মধ্যে সাত বছরে মাত্র একটি উদ্ধার করতে পেরেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে সোয়া দুই বছরেও ওই হলের জমির দীর্ঘমেয়াদি ইজারা নিতে পারেনি। ছাত্রী হলের জন্য একটি জায়গা দখলে নিয়ে চার মাস আগে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হলেও এখনো দরপত্র আহ্বান করা হয়নি।
বেদখলে থাকা হলগুলো উদ্ধার এবং নতুন হল নির্মাণের দাবিতে ২০০৭ সাল থেকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আবাসন সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অর্জন এটুকুই। হল উদ্ধারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের করা কমিটিও দেড় বছর ধরে নিষ্ক্রিয়। ফলে ২০০৫ সালের ২০ অক্টোবর প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীদের জন্য এখনো কোনো আবাসন-সুবিধা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী প্রায় ১৫ হাজার, যাঁদের অনেকে রাজধানীর বাইরে থেকে আসা। হল না থাকায় তাঁদের বাসাবাড়ি ভাড়া নিয়ে মেস করে থাকতে হয়। এ ক্ষেত্রে ছাত্রীদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয় বেশি।
বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার আগে এটি ছিল জগন্নাথ কলেজ। কলেজের ১১টি হল আশির দশকের বিভিন্ন সময়ে ছাত্রদের উচ্ছেদ করে দখল করেন স্থানীয় লোকজন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। জমির বৈধ কাগজপত্র না থাকায় তৎকালীন কলেজ কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিতে পারেনি।
বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর হলগুলো উদ্ধারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। বড় আন্দোলনটি হয় ২০০৯ সালে। ২৭ জানুয়ারি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে শতাধিক আহত হন এবং এরপর ২৯ দিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ছিল। সর্বশেষ আন্দোলন শুরু হয়েছে গত ১২ ফেব্রুয়ারি। আগের সব আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীরা নেতৃত্ব দিলেও এবার নেতৃত্ব দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতারা। এ আন্দোলনে শিক্ষকেরাও যোগ দিয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মকর্তা জানান, বছর পাঁচেক আগে অন্তত পাঁচটি হল উদ্ধারে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দুর্বলতা ও অদক্ষতার কারণে সেগুলো আয়ত্তে আনা যায়নি।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠিত ১৩ সদস্যের হল উদ্ধার কমিটির কার্যক্রম নেই প্রায় দেড় বছর। এমনকি এই কমিটির বৈঠকও হয় না। চলমান আন্দোলনেও এটি নিষ্ক্রিয়।
বিষয়টি স্বীকার করে এই কমিটির সদস্য কাজী সাইফুদ্দিন বলেন, ‘ছয়টি হল আমাদের করায়ত্তে চলে এসেছিল। তবে একটি উদ্ধার করা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যথেষ্ট উদ্যোগী না হওয়ায় বাকিগুলো উদ্ধার করা যায়নি।’
অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মীজানুর রহমান সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘হলগুলোর বেশির ভাগের জমির কাগজপত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে নেই।’ ২৫ ফেব্রুয়ারি এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘হল উদ্ধারে সব কার্যক্রম অব্যাহত আছে। এ ব্যাপারে আমি সরকারের সর্বোচ্চ মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি।’
ভিত্তিপ্রস্তরেই থেমে আছে ছাত্রী হল: একটি ছাত্রী হল নির্মাণে প্রায় সাড়ে তিন বছর আগে ৪০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সরকার। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্টো পাশে বাংলাবাজার বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের মূল ফটক-সংলগ্ন পরিত্যক্ত থাকা ২২ কাঠা জমি ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রলীগ দখলে নেয়। ওই জমিতে ‘বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল’ নামে একটি ছাত্রী হল নির্মাণে গত বছরের ২২ অক্টোবর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। জমিটি দীর্ঘ মেয়াদে ইজারা নিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রায় দেড় কোটি টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিয়েছে। তবে একটি পক্ষ মামলা করায় বিষয়টি ঝুলে আছে।
এদিকে ২০১১ সালের অক্টোবরে মালিটোলায় ৯.৩৯ কাঠার হাবিবুর রহমান হলটি উদ্ধার করে শিক্ষার্থীরা। পরে জমিটি দুই বছরের জন্য ইজারা নেয় বিশ্ববিদ্যালয়। ওই মেয়াদ শেষে কর্তৃপক্ষ জমিটি দীর্ঘ মেয়াদে ইজারা নিতে আবেদন করে। তা না পেয়ে জমিটি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু করে। হল উদ্ধার কমিটির সদস্যসচিব ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-রেজিস্ট্রার শেখ রেজাউল করিম বলেন, ‘অধিগ্রহণ ও ইজারা নেওয়ার কাজ চলছে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার জন্য দেরি হচ্ছে। হাবিবুর রহমান হলের জমি অধিগ্রহণ চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে।’
চিঠি চালাচালির সাত বছর: আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৭ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য সিরাজুল ইসলাম খান হল উদ্ধারের বিষয়ে উদ্যোগ নেন। তিনি বেদখল হওয়া হলসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পত্তির তথ্য জানতে ১৮ লাখ টাকা ব্যয়ে বেসরকারি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করেন। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২০০৮ সালে হলগুলো উদ্ধারের প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করতে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। ওই আবেদনের প্রায় নয় মাস পর শিক্ষা মন্ত্রণালয় হল উদ্ধারে সহায়তার অনুরোধ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয়। এ নিয়ে কয়েক দফা চিঠি চালাচালি হয়।
২০০৯ সালের আন্দোলনের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে হল উদ্ধারে করণীয় ঠিক করতে ছয় সদস্যের কমিটি হয়। কমিটি শহীদ আনোয়ার শফিক, শহীদ আজমল হোসেন, শহীদ শাহাবুদ্দিন, তিব্বত ও হাবিবুর রহমান হলের ইজারা বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে দেওয়ার সুপারিশ করে। বিশ্ববিদ্যালয় ওই বছরের ৫ মে জমির দীর্ঘস্থায়ী ইজারা পেতে ভূমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে। মন্ত্রণালয় ব্যবস্থা নিতে বলে জেলা প্রশাসনকে।
পরে জেলা প্রশাসনের প্রতিবেদনে বলা হয়, নানা জটিলতা থাকায় হাবিবুর রহমান হল ছাড়া অন্য কোনোটি ইজারা দেওয়া সম্ভব নয়। সরকারের মাধ্যমে জনস্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়কে হলগুলোর জমি অধিগ্রহণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
২০১০ সালের আগস্টে আবদুর রহমান, শহীদ আনোয়ার শফিক, সাইদুর রহমান ও আবদুর রউফ মজুমদার (দুটি মিলে একটি হল) এবং শহীদ নজরুল ইসলাম হল অধিগ্রহণের জন্য শিক্ষা ও ভূমি মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে বিশ্ববিদ্যালয়। ভূমি মন্ত্রণালয় থেকে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসনকে চিঠি দেওয়া হয়। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে অধিগ্রহণের জন্য চূড়ান্ত আবেদন করে বিশ্ববিদ্যালয়।
হল উদ্ধারে গত রোববার স্থানীয় সাংসদ কাজী ফিরোজ রশীদকে আহ্বায়ক করে আট সদস্যের কমিটি করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কমিটিকে হল উদ্ধারে করণীয় ঠিক করে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।