সেন্টুশাইল চাষে বাজিমাত

নালিতাবাড়ীতে গত তিন মৌসুমে স্থানীয়ভাবে উদ্ভাবিত সেন্টুশাইল ধান চাষ করে কৃষকেরা লাভের মুখ দেখেছেন। উপজেলার অনেক কৃষক এখন ঝুঁকছেন এই ধান চাষের দিকে। এই ধানের উদ্ভাবক কৃষক সেন্টু কুমার হাজং এখন সারা দেশের কৃষকের মধ্যে এই জাতের ধান চাষ ছড়িয়ে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন।

সেন্টু হাজংয়ের (৪৮) বাড়ি নালিতাবাড়ীর চাটকিয়া গ্রামে। সাত বছর ধরে একক প্রচেষ্টায়বিআর-১১ ধানের সঙ্গে স্থানীয় জাতের চিনিশাইল ধানের সংকরায়ণ করছেন তিনি। এভাবে ২০১৬ সালে তিনি নতুন জাতের ধান উদ্ভাবন করেন। তাঁর নামের সঙ্গে মিলিয়ে এই ধানের নাম রাখা হয় ‘সেন্টুশাইল’। এই ধানের চাল আতপ ও তুলসীমালা ধানের মতো চিকন হয়। ফলনও পাওয়া যায় বেশ। প্রতি একরে ৪৫ থেকে ৫৫ মণ। ধানগাছের উচ্চতা হয় সাড়ে তিন থেকে চার ফুট। গাছ শক্ত থাকায় সহজে বাতাসে হেলে পড়ে না। বীজতলা তৈরি থেকে ফসল কাটা পর্যন্ত সেন্টুশাইল উৎপাদনেসময় লাগে ১৪০ থেকে ১৫০ দিন।আর তুলসীমালার সময়কাল ১৮০ দিন। সেন্টুশাইল ধান চাষে তেমন কোনো পরিচর্যা লাগে না। পোকামাকড়ের আক্রমণও কম হয়। দাম পাওয়া যায় তুলসীমালা ধানের মতোই।

সেন্টু হাজং বলেন, এই ধানের জাত প্রথমে তাঁর কাছ থেকে অনেক কৃষক নিয়েছেন। এখন এই ধানের বীজ স্থানীয় বাজারেও বিক্রি হয়। এভাবেই কৃষকেরা এই ধানের বিস্তার ঘটিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি চাই নতুন এ জাতটি সরকারি উদ্যোগে সারা দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হোক।’

গত বছরের ৬ জানুয়ারি প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ‘গ্রামের দুই ধানবিজ্ঞানী’ নামে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে নালিতাবাড়ীর সেন্টু হাজং এবং বরগুনার পাথরঘাটার কৃষক মীর আবদুল আজিজের ব্যক্তিপ্রচেষ্টায় ধানের জাত উদ্ভাবনের কাহিনি উঠে আসে। এরপর সেন্টু হাজংয়ের উদ্ভাবিত ধানের জাতের চাষ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে।

গত আমন মৌসুমে পাঁচ একর জমিতে সেন্টুশাইল ধানের চাষ করেন নালিতাবাড়ীর কয়ড়াকুড়ি গ্রামের কৃষক নিরঞ্জন হাজং। একরে তিনি ফলন পেয়েছেন ৪৫ থেকে ৪৬ মণ। একরপ্রতি খরচ হয়েছে ১২ হাজার টাকা। মণপ্রতি ধানের দাম পেয়েছেন ১ হাজার ৮৫০ টাকা। পাঁচ একর জমিতে তিনি গড়ে ধান পেয়েছেন ২৫০ মণ। সেই ধান বাজারে বিক্রি করে তিনি পেয়েছেন ৪ লাখ ৬২ হাজার টাকা। খরচ বাদ দিয়ে তাঁর লাভ হয়েছে ৪ লাখ ২ হাজার টাকা। চলতি বছরও তিনি পাঁচ একর জমিতে সেন্টুশাইল ধানের আবাদ করেছেন।

চলতি মৌসুমে সেন্টু হাজং ও অন্যান্য কৃষকের কাছ থেকে বীজধান নিয়ে উপজেলায় দেড় হাজার কৃষক সেন্টুশাইলের আবাদ করেছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চলতি মৌসুমে ফলন হয়েছে ভালো। চাষিরা একরে ৪৫ থেকে ৫৫ মণ হারে ধান পাওয়ার আশা করছেন।

সম্প্রতি উদ্ভাবক সেন্টু হাজংয়ের বাড়ির আঙিনায় সেন্টুশাইল ধানের ওপর মাঠ দিবস অনুষ্ঠিত হয়। এতে সহায়তা করে কারিতাস ময়মনসিংহ অঞ্চলের এলআরডি প্রকল্প। মাঠ দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল ‘সমাজভিত্তিক বীজভান্ডার গড়ে তুলি, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ গড়ি’। কর্মসূচিতে এলাকার ২০০ কিষান-কিষানি উপস্থিত হন। অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. শরীফ ইকবাল, নালিতাবাড়ীতে বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা উপকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাসরিন আক্তার ও কনিষ্ঠ পরীক্ষণ কর্মকর্তা আবদুর রহমান।

অনুষ্ঠানে সেন্টুশাইল ধানের উৎপাদন, সময়কাল, পরিচর্যা, বাজারমূল্য নিয়ে কথা বলেন কয়েকজন কিষান-কিষানি। নয়াবিল গ্রামের কৃষক কোরবান আলী জানান, দুই একর জমিতে তিনি তিন বছর ধরে স্থানীয় জাতের সেন্টুশাইল ধান চাষ করছেন। দুই একর জমিতে তিনি প্রতিবছর গড়ে ধান পেয়েছেন ১০০ মণ করে। প্রতি মণ ধান বিক্রি করেছেন ১ হাজার ৮০০ টাকায়। এবারও তিনি দুই একর জমিতে সেন্টুশাইল চাষ করেছেন। ফলন হয়েছে ভালো। কয়েক দিনের মধ্যে ধান কাটবেন তিনি। আশা করছেন একরে ৫০ থেকে ৫৫ মণ হারে ধান পাওয়া যাবে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শরীফ ইকবাল বলেন, সেন্টু হাজংয়ের উদ্ভাবিত স্থানীয় জাতের সেন্টুশাইল ধান চাষে কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। চলতি বছর প্রায় ১ হাজার একর জমিতে এই ধান চাষ করা হয়েছে। এই ধান একরে ৪৫ থেকে ৫০ মণ হয়। চাল চিকন হওয়ায় এবং দাম বেশি থাকায় এই ধান চাষে কৃষকেরা অনেক লাভবান হয়েছেন।

পরমাণু কৃষি গবেষণা উপকেন্দ্রের কর্মকর্তা নাসরিন আক্তার বলেন, ‘কৃষক সেন্টু হাজংয়ের উদ্ভাবিত সেন্টুশাইল ধান আমরা আরও পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে দেখব। পরে বীজ প্রত্যয়ন বিভাগে পাঠানো হবে। সেখানেও যদি ভালো ফলাফল পাওয়া যায়, তাহলে সারা দেশের কৃষকের মধ্যে এই বীজ ছড়িয়ে দেওয়া হবে।’