বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই পেতে আকুতি জাহাঙ্গীরের

প্রায় প্রতিদিনই ঝিম মেরে বসে থাকতে দেখা যায় বয়স্ক লোকটাকে। শরীর জীর্ণশীর্ণ। পরনের পোশাক ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত। প্রথম দিকে মনে হচ্ছিল লোকটা মানসিক ভারসাম্যহীন। রাজধানীর কারওয়ান বাজার রেলগেটের পাশে ফুটপাতের সঙ্গে আছে কংক্রিটের তৈরি বসার স্থান। সেখানেই বেশির ভাগ সময় তাঁকে থাকতে দেখা যায়।

সম্প্রতি কারওয়ান বাজারে কর্মস্থলে যেতে কৌতূহলবশত তাঁর সঙ্গে কথা হলো। এতে জানা গেল সংসারি এক মানুষের পথে বসার গল্প। তাঁর নাম মো. জাহাঙ্গীর। নিজের বয়স ঠাহর করতে পারেন না। দেখে মনে হয় ৫৫ থেকে ৬০ বছর হবে। বছর তিনেক আগে স্ট্রোক করেন তিনি। এতে শরীরের ডান পাশ তাঁর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়। শুরু হয় দুর্বিষহ জীবন। সেই জীবনেরই এখন ঘানি টানছেন তিনি।

একটি ক্রাচে ভর করে এক পায়ে খুঁড়িয়ে-খুঁড়িয়ে হাঁটেন জাহাঙ্গীর। বেশির ভাগ সময় বসে থাকেন। কেউ সহযোগিতায় হাত বাড়ালে গোসল করার সৌভাগ্য হয়। নতুবা গোসল না করেই কেটে যায় দিন, সপ্তাহ থেকে দু-তিন মাস। প্রস্রাব–পায়খানা সারেন আশপাশেই। ফলে দুর্গন্ধে তাঁর পাশে থাকা কঠিন। গভীর আক্ষেপে জাহাঙ্গীর বললেন, ‘কেউ যদি আমারে নিয়মিত সেবা করত, চিকিৎসা করত, তবে আমি ভালো হইয়া যাইতাম। কিন্তু কেউ আমার খোঁজ করে না।’

ফুটপাতের পাশেই বসে থাকেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত জাহাঙ্গীর। রেলগেট–সংলগ্ন এলাকা, কারওয়ান বাজার, ঢাকা। ছবি: প্রথম আলো
ফুটপাতের পাশেই বসে থাকেন পক্ষাঘাতগ্রস্ত জাহাঙ্গীর। রেলগেট–সংলগ্ন এলাকা, কারওয়ান বাজার, ঢাকা। ছবি: প্রথম আলো

পরিত্যক্ত কাঁথা, থালা-বাসন ও একটি বোতল নিয়ে ফুটপাতে খোলা আকাশের নিচে একাকী সংসার পেতেছেন জাহাঙ্গীর। অবশ্য সম্প্রতি তিনি মাথার ওপর একটি ছাউনি টাঙিয়েছেন, সেটাও ছিঁড়ে যাচ্ছে। রোদ, ঝড়-বৃষ্টি ও শীত সেখানেই কাটছে তাঁর। পথচারীদের কাছে হাত পেতে যা পান, তা দিয়ে খাবার কেনেন। টাকা না পেলে থাকতে হয় না খেয়ে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে এভাবেই চলছে তাঁর দিনরাত। নিঃসঙ্গ এমন দুঃসহ জীবন থেকে মুক্তির জন্য অনেক পথচারীর কাছে দাবি জানিয়েছেন। করছেন বৃদ্ধাশ্রমে ঠাঁই পাওয়ার আকুতি। কিন্তু কেউ তাঁর আহ্বানে সাড়া দেয়নি।

পথচারীদের কাছে টাকার জন্য হাত পাতেন তিনি। রেলগেট, কারওয়ান বাজার, ঢাকা। ছবি: প্রথম আলো
পথচারীদের কাছে টাকার জন্য হাত পাতেন তিনি। রেলগেট, কারওয়ান বাজার, ঢাকা। ছবি: প্রথম আলো

জাহাঙ্গীরের ভাষ্যমতে, ৮ থেকে ১০ বছর গাজীপুরে লোকাল বাসের কন্ডাক্টরি করেন। এরপর রাজধানীর বাড্ডায় পুলিশের সোর্সের কাজ করেছেন। পরিবার নিয়ে থাকতেন ঢাকার পল্লবী থানার বাউনিয়া এলাকায়। স্ত্রী ও একমাত্র কন্যাসন্তান নিয়ে ভালোই কাটছিল তাঁর সংসার। কিন্তু কীভাবে যে ভাগ্যে ‘শনির দশা’ লাগল বুঝতেই পারছেন না। হঠাৎ তাঁর পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হলেন। স্ত্রী অন্যত্র বিয়ে করে চলে গেলেন। নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে ঠাঁই নিল তাঁর নানির বাড়ি নড়াইলে।

মা–বাবার একমাত্র সন্তান জাহাঙ্গীর। শৈশব-কৈশোর কেটেছে বিক্রমপুরে (মুন্সিগঞ্জে) নানির বাড়িতে। নানা-নানি ও মা–বাবা কেউ এখন বেঁচে নেই। স্বজন বলতে আছে শুধু ছয়জন সৎভাই ও এক সৎবোন। অবশ্য সব স্বজনের আশা ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। কেউ যদি এসে তাঁকে বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে যান, সেটাই হবে তাঁর জন্য সুসংবাদ।

নিজের বয়স ঠাহর করতে পারেন না জাহাঙ্গীর। দেখে মনে হয় ৫৫ থেকে ৬০ বছর হবে। ছবি: তৌহিদুল ইসলাম
নিজের বয়স ঠাহর করতে পারেন না জাহাঙ্গীর। দেখে মনে হয় ৫৫ থেকে ৬০ বছর হবে। ছবি: তৌহিদুল ইসলাম

এ বিষয়ে আজ মঙ্গলবার সন্ধ্যায় দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় রাজধানীর কল্যাণপুর পাইকপাড়ায় অবস্থিত অসহায় শিশু ও বৃদ্ধদের আশ্রয় দেওয়া সামাজিক প্রতিষ্ঠান চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এইজ কেয়ারের। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক মিল্টন সমাদ্দার বলেন, তিনি চট্টগ্রামে আছেন। ঢাকায় ফিরে ওই ব্যক্তিকে তাঁর প্রতিষ্ঠানে আশ্রয় দিতে ব্যবস্থা নেবেন। অথবা কেউ যদি তাঁর প্রতিষ্ঠানে ওই ব্যক্তি পাঠিয়ে দেন, তাহলেও তিনি তাঁকে আশ্রয় দেবেন। মিল্টন সমাদ্দার আরও বলেন, ‘এমন মানুষ আমাদের প্রিয়জন। তাঁদের কারণে আমরা পৃথিবী উপভোগ করতে পারছি। তাঁদের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ব পালন আমাদের সবার মানবিক কর্তব্য।’