মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, তারা মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে রাজাকারের কোনো তালিকা দেয়নি। তাদের কাছে রাজাকারের কোনো তালিকা নেই। ১৯৭২ সালে দালাল আইনে যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সেই তালিকাই মন্ত্রণালয় থেকে চাওয়ার পর ‘পেনড্রাইভে’ করে পাঠানো হয়েছে। গোপন এ তালিকা প্রকাশ করার বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়নি। এমনকি প্রকাশিত এ তালিকার পাতায় পাতায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তার কোনো সইও নেই। সংবাদ সম্মেলনে ডাকা হয়নি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো কর্মকর্তাকে। এমন একটি তালিকা প্রকাশ করার পুরো দায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বলে দাবি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় এ তালিকা প্রকাশের দায় নিলেও তালিকাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে পেয়েছে বলে দাবি করছে। তারা বলছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে রাজাকারের তালিকা চাওয়ার পর তাদের এই তালিকা দেওয়া হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তালিকায় কার নাম যুক্ত করেছে বা বাদ দিয়েছে কি না, তা তাদের জানা নেই।

১৫ ডিসেম্বর ‘একাত্তরের রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও স্বাধীনতাবিরোধী তালিকা প্রকাশ—প্রথম পর্ব’ শিরোনামে ১০ হাজার ৭৮৯ জনের নামের এই তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরপর থেকে সারা দেশে এ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে।

গত ২৮ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধের সময় বেতন-ভাতা নেওয়া রাজাকারদের তালিকা জেলা প্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সংগ্রহের সুপারিশ করা হয়। পরে ২১ মে জেলা প্রশাসকদের চিঠি দিয়ে তালিকা চাওয়া হয়। প্রথম চিঠিতে শুধু তালিকা সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হলেও গত ২৮ আগস্ট আবারও তালিকা পাঠানোর জন্য তাগিদ দিয়ে জেলা প্রশাসকদের চিঠি দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময়কালের রাজাকারদের তালিকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে রয়েছে। মূলত জেলা প্রশাসনেই থাকে এগুলো। তবে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত মাত্র ১১টি জেলা থেকে প্রতিবেদন আসে। এর মধ্যে চাঁদপুরে ৯ জন, মেহেরপুরে ১৬৯ জন, শরীয়তপুরে ৪৪ জন, বাগেরহাটে ১ জন ও নড়াইল থেকে ৫০ জন রাজাকারের তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। অন্য ছয়টি জেলা থেকে শূন্য প্রতিবেদন আসে। বাকি জেলা প্রশাসকেরা জানান, তাঁদের জেলার রেকর্ডরুমে রাজাকারদের নামের তালিকা তাঁরা পাননি।

এদিকে মে মাসেই মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আধা সরকারি পত্র দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে তালিকা চায়। মন্ত্রণালয় জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক ও আইসিটি) আবু বকর ছিদ্দীককে এ বিষয়টি খোঁজ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। জানতে চাইলে আবু বকর ছিদ্দীক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা খোঁজ করে দালাল আইনের ৯০২টি নথির খোঁজ পাই, যেখানে ১০ হাজার ৭৮৫ জনের নাম উল্লেখ ছিল। সেখানে রয়েছে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের নামও। কোনো কোনো মামলায় ৪২১ জনের নামও রয়েছে। আমরা বিভাগ অনুযায়ী ভাগ করে পুরো তালিকাটি যোগ করে দিয়েছি নিজেদের সংগ্রহে রাখার জন্য। এরই মধ্যে মন্ত্রী মৌখিকভাবে টেলিফোনে তালিকাটি পাঠানোর নির্দেশ দেন। আমরা বলেছি আমাদের কাছে রাজাকারের তালিকা নেই। আছে দালাল আইনে যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সেই তালিকা। তালিকায় যাঁদের নাম রয়েছে তাঁদের মধ্যে ৯৯৬ জন সাধারণ ক্ষমাও পেয়েছিলেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ দায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের। আমরা তাদের যে তালিকা দিয়েছি, তা তারা প্রকাশ করবে বলেনি। সংবাদ সম্মেলন করবে, সেটাও জানায়নি। আর আমরা বলিনি, এটা রাজাকারের তালিকা। আমরা প্রথম থেকে দালাল আইনে করা মামলার তালিকার কথাই তাদের বলেছি। তাদের উচিত ছিল যাচাই-বাছাই করে এ ধরনের একটি স্পর্শকাতর তালিকা প্রকাশ করা।’

মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি দালাল আইনে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আদেশ জারি করা হয়। এই দালাল আইনের আলোকে ৩৭ হাজারের বেশি মানুষকে আটক করা হয়। সারা দেশে ৭৩টি বিশেষ আদালতে তাঁদের অপরাধের বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর দালাল আইনে যাঁদের বিরুদ্ধে স্পষ্ট অভিযোগ পাওয়া যায়নি, তাঁদের জন্য সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে। এ ঘোষণার পর দালাল আইনে আটক ৩৭ হাজারের বেশি ব্যক্তির ভেতর থেকে ২৫ হাজার ৭১৯ জন আসামি ছাড়া পান। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর সামরিক অধ্যাদেশ জারি করে দালাল আইন বাতিল করা হয়।

এ ধরনের বিতর্কিত তালিকা কেন প্রকাশ করলেন, জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পেনড্রাইভে যে তালিকা পাঠানো হয়েছে, সেটাই আমরা প্রকাশ করেছি। এ ক্ষেত্রে আমাদের কী দায় থাকতে পারে। আমরা তো রাজাকারের তালিকাই চেয়েছিলাম। তবে ভুল করে কারও নাম এ তালিকায় থেকে গেলে আবেদন করলে আমরা তদন্ত করে সংশোধন করব।’