মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বারবার কেলেঙ্কারি করছে: মুনতাসীর মামুন

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা। ছবি: প্রথম আলো
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা। ছবি: প্রথম আলো

রাজাকারের তালিকা প্রকাশের ঘটনা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বারবার কেলেঙ্কারি করছে। বিভিন্ন অনিয়মের ঘটনা বারবার ঘটে গেলেও কোনোটার বিচার হয়নি। তিনি রাজাকারদের ত্রুটিপূর্ণ তালিকা প্রকাশের দায়ে বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছেন।

আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির এক সংবাদ সম্মেলনে মুনতাসীর মামুন এসব কথা বলেন। স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অন্তর্ভুক্তির কারণ এবং দায়ী ব্যক্তিদের শনাক্তকরণের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়ে এ সংবাদ সম্মেলন করা হয়।

মুনতাসীর মামুন বলেন, মন্ত্রণালয় অনেককে সার্টিফিকেট দিয়েছে, যাঁরা সচিব বা উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। সরকার পরে তাঁদের চাকরিচ্যুত করেছে বা অবসরে গেছেন। এই জালিয়াতির বিরুদ্ধে কি কোনো কিছু করা হয়েছে? কোনো মামলা হয়েছে? বিদেশি বন্ধুদের সম্মাননা দেওয়ার জন্য যে ক্রেস্ট কেলেঙ্কারি হলো, সেটার বিচার হয়েছে? এই মন্ত্রণালয়েরই একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সার্টিফিকেট ভুয়া প্রমাণিত হয়েছে। তাঁর কি কোনো শাস্তি হয়েছে? তিনি আরও বলেন, এ জন্যই তাঁরা তদন্ত ও শাস্তি দাবি করছেন। আগে হয়নি বলেই সাহস পেয়ে রাজাকারের তালিকা প্রকাশে এ কাজটি করা হয়েছে। এ ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে যদি ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, ভবিষ্যতে এ রকম কিছু ঘটবে না, এর নিশ্চয়তা কে দেবে।

এই তালিকা ১৯৭১ সালের তালিকা নয় জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক এই গবেষক বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচিত ছিল তালিকা দেওয়ার আগে যাচাই করা। মুনতাসীর মামুন বিভিন্ন বই ও গবেষণার সূত্র তুলে ধরে বলেন, ‘এতগুলো বিষয় থাকার পরও কীভাবে কেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে তালিকা চেয়ে একটা পেনড্রাইভে করে এনে প্রকাশ করল? এটা রহস্যজনক।’

বেসরকারিভাবে বিভিন্ন তালিকা থাকার পরও এমন প্রশ্নবিদ্ধ তালিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলে মুনতাসীর মামুন বলেন, যাঁরা করেছেন তাঁরা ইতিহাসের সঙ্গেও যুক্ত নন। তিনি জানান, শিক্ষা, সংস্কৃতি, যুব ও ক্রীড়া, মুক্তিযুদ্ধ—এ ধরনের মন্ত্রণালয়ের নাগরিক সমাজের সঙ্গে কাজ করতে হবে।

স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের নাম আসায় কোনো আইনি পদক্ষেপের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে একাত্তরে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘তদন্তের পর কমিশনই সিদ্ধান্ত নেবে কী ধরনের বিচার হবে। আমরা মামলা করব কেন? মামলা করার দায়িত্ব সরকারের।’ তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এখানে টেম্পারিং হতে পারে। এটা তদন্ত কমিশন খুঁজে বের করবে। বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় থাকতে তাদের পরিচিত রাজাকারদের নাম তুলে দিয়ে পরিচিত মুক্তিযোদ্ধার নাম ঢোকাতে পারে তালিকা প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য বা বাতিল করার জন্য।’ মন্ত্রীর পদত্যাগ প্রসঙ্গে বলেন, মন্ত্রীর অপসারণই সমাধান না। তাঁরা বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন দাবি করেছেন। যার চেয়ারম্যানকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতির সমমর্যাদার হতে হবে।

লিখিত বক্তব্যে শাহরিয়ার কবির বলেন, এই তালিকায় কোনো মুক্তিযোদ্ধার নাম বা শহীদ পরিবারের নাম যুক্ত হওয়া শুধু ভুল নয়, গুরুতর অপরাধ। এটা গোটা জাতির অপমান, যা বিজয়ের মাসে ঘটেছে। তালিকা নিয়ে ক্ষোভ জানার সঙ্গে সঙ্গে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি নিজ উদ্যোগে তদন্তও করেছে বলে জানান।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সম্প্রতি বলেছেন, ৪৮ বছর পর রাজাকারের তালিকার প্রয়োজন কী। এই বক্তব্যের সমালোচনা করে শাহরিয়ার কবির বলেন, ১৯৭১-এর ঘাতক দালালদের পুনর্বাসনের কাজ বিএনপি এখনো নিষ্ঠার সঙ্গে অনুসরণ করে আসছে। যে কারণে রাজাকারের তালিকা প্রকাশের উদ্যোগের বিরোধিতা করছে বলে অভিযোগ করেন। তাঁরা বিএনপির সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি আরও বলেন, ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে মুক্তিযুদ্ধের বহু নথিপত্র নষ্ট বা বিকৃত করা হয়েছে। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তর থেকে স্বাধীনতাবিরোধীদের দোসরদের এখনো হটানো যায়নি।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি রাজাকারদের তালিকা তৈরি, বধ্যভূমি শনাক্তকরণ, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরিসহ বিভিন্ন গবেষণামূলক কাজের দায়িত্ব শুধু আমলাদের হাতে ছেড়ে না দিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও গবেষকদের এখানে যুক্ত করার দাবি জানায়। তাঁরা আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী উদ্‌যাপনের আগেই স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকা তৈরির কাজ সম্পন্ন করা প্রয়োজন। তাঁরা প্রস্তাব করেন, ১৮টি ভিন্ন অপরাধের প্রমাণ না থাকার কারণের যাদের ১৯৭৩ সালে সাধারণ ক্ষমা করা হয়, তাদের এই তালিকা থেকে বাদ রাখা; আত্মগোপনে বা দেশের বাইরে থাকা সব গুরুত্বপূর্ণ স্বাধীনতাবিরোধী ও গণহত্যাকারীর নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা; অপরাধীদের পূর্ণাঙ্গ নাম-ঠিকানা ও কোন ঘাতক সংগঠনের সদস্য ছিল, তার উল্লেখসহ অপরাধের সংক্ষিপ্ত বিবরণ থাকা প্রয়োজন।

সংবাদ সম্মেলনে আরও বক্তব্য দেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহসভাপতি শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী, সহসাধারণ সম্পাদক কামরুজ্জামান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুর মেয়ে ডানা নাজলী, মুক্তিযোদ্ধা মির্জা আবদুল লতিফের মেয়ে সেলিনা মির্জা, মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালামের মেয়ে জুলফিয়া বেগম।