স্কুলের সাফল্য কলেজে ম্লান

পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্রাবাস। গত বুধবার দুপুরে।   জুয়েল শীল
পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্রাবাস। গত বুধবার দুপুরে। জুয়েল শীল

মাধ্যমিক পর্যায়ের ফলাফলে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রায় প্রতিবছরই জিপিএ–৫ পাওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষেই থাকে। কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকের ফলাফলে এই সাফল্য একেবারেই বিবর্ণ। এই চিত্র চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজের।

ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চলতি বছর এসএসসিতে ৪৫৭ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে ৪১১ জনই জিপিএ–৫ পেয়েছে। অন্যদিকে এইচএসসিতে ১৬৫ জন পরীক্ষার্থীর মধ্যে জিপিএ–৫ পেয়েছে মাত্র ১৩ জন।
শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিষ্ঠানটিতে বিদ্যালয় শাখায় নিয়মিত ক্লাস হয়। সেখানে শিক্ষকও আছেন পর্যাপ্ত। কিন্তু কলেজ শাখায় নেই কোনো নিজস্ব শিক্ষক। বিদ্যালয় শাখার শিক্ষকেরাই ক্লাস নেন। ফলে ক্লাসও অনিয়মিত। কলেজ শাখার প্রায় সব শিক্ষার্থীকে কোচিং ও প্রাইভেটের ওপর নির্ভর করতে হয়। একমাত্র ছাত্রাবাসটি বন্ধ প্রায় দুই বছর ধরে। এ জন্য দূর–দূরান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীদের থাকতে হয় বাইরে।

চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল দেশের সবচেয়ে পুরোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির একটি। ১৮৩৬ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেনা–সমর্থিত সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮-০৯ শিক্ষাবর্ষে এখানে একাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান ও বাণিজ্য বিভাগে ছাত্র ভর্তি শুরু হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে শিক্ষার্থী আছে ২ হাজার ৬৪৭ জন। তাদের মধ্যে বিদ্যালয় শাখায় ২ হাজার ২৮৭ জন। বাকি ৩৬০ জন কলেজ শাখার।

দেশের একমাত্র নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস মাধ্যমিক শিক্ষার পাট চুকিয়েছেন এই বিদ্যালয় থেকে। শুধুই কি ইউনূস! এই বিদ্যালয়ে পড়েছেন কবি নবীনচন্দ্র সেন, নিখিল ভারত কংগ্রেসের সভাপতি ও কলকাতা করপোরেশনের পরপর তিনবার নির্বাচিত মেয়র দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেন, বরেণ্য বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম ও সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।
ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে বিদ্যালয় শাখায় পঞ্চম ও নবম শ্রেণিতে প্রতিবছর শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় এখানে। এর সঙ্গে অষ্টম শ্রেণিতে আসন খালি থাকা সাপেক্ষে বেশ কিছু শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়।

স্কুলের শিক্ষক দিয়ে কলেজের ক্লাস
এসএসসির ফলাফলে গত ১৯ বছরের মধ্যে ১৭ বছর কলেজিয়েট স্কুল চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডে শীর্ষে ছিল। ছয়বার দেশের মধ্যে প্রথম স্থান অর্জন করে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) পরীক্ষায় এই প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের সেরাদের একটি। কিন্তু কলেজ শাখা খোলার ১১ বছর পার হয়ে গেলেও এইচএসসির ফলাফলের দিক দিয়ে এই বোর্ডের সেরা ১০টি সেরা কলেজের মধ্যেও জায়গা হয়নি প্রতিষ্ঠানটির।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে শিক্ষক আছেন ৫৮ জন। কিন্তু একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা কোনো শিক্ষক নেই। ফলে বিদ্যালয় শাখার শিক্ষকেরাই সেখানে ক্লাস নেন। অন্তত ২০ জন শিক্ষক কলেজ শাখায় ক্লাস নিচ্ছেন। এ কারণে একদিকে স্কুল শাখার শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে, অন্যদিকে কলেজ শাখায়ও পরিপূর্ণভাবে কার্যক্রম হচ্ছে না।
কলেজের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, নিয়মিত ক্লাস হয় না। শিক্ষকেরাও শ্রেণিকক্ষে তাদের সন্তুষ্ট করতে পারেন না। শিক্ষার্থীরা প্রায় সবাই কোচিং ও বাইরের শিক্ষকদের কাছে প্রাইভেটের ওপর নির্ভরশীল।

গত বৃহস্পতি ও রোববার এই প্রতিষ্ঠানে কথা হয় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে। বিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের দুজন শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলে, ‘খুবই হতাশার মধ্যে আছি। নিয়মিত ক্লাস হয় না। হলেও তা নামকাওয়াস্তে। প্রায় ক্ষেত্রেই আমাদের প্রশ্নের সন্তোষজনক জবাব পাই না।’

অন্যদিকে একই বিভাগের প্রথম বর্ষের তিনজন শিক্ষার্থীও একই কথা বলে। তারা চট্টগ্রাম কলেজের কয়েকজন শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়ে।
তবে বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের পাঁচজন ক্লাসের বিষয়ে সন্তোষজনক উত্তর দেয়। তারা বলে, প্রায় সময় ক্লাস হয়। তবে বাড়তি জানার জন্য বেশ কিছু বিষয়ে তারা বাইরে কোচিংয়ে পড়ে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা ও বাণিজ্য উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমানের সময় এই প্রতিষ্ঠানে কলেজ শাখা খোলা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কলেজ পর্যায়ে আসনস্বল্পতা ছিল। তাই চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বিদ্যালয়ে কলেজ শাখা খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতার অভাবে কলেজ শাখায় শিক্ষক নিয়োগ করা হয়নি।
কলেজ শাখায় আলাদা শিক্ষক দেওয়ার চেষ্টা করছেন বলে জানান প্রধান শিক্ষক দেবব্রত দাশ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমানে যেসব শিক্ষকের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভালো ফল আছে, তাঁদের দিয়ে কলেজ শাখায় ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। কলেজ শাখায় প্রতি বিভাগে অন্তত একজন করেও যেন শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়, সেই দাবি বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছি।’

আরও যত সমস্যা
১১ একরের বিশাল জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে কোনো মিলনায়তন নেই। উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও নিরাপদ পানীয় জলেরও অভাব আছে। অন্যদিকে বিদ্যালয় শাখায় কক্ষগুলো তৈরি করা হয়েছিল ৪০ জন ছাত্রের বসার হিসাব করে। কিন্তু বর্তমানে ৮০ জন শিক্ষার্থীকে এক একটি কক্ষে ক্লাস করতে হয়। ফলে ক্লাসে শিক্ষার্থীদের হিমশিম খেতে হয়।
নাম প্রকাশ না করে দুজন অভিভাবক ও কয়েকজন শিক্ষক প্রথম আলোকে বলেন, সার্বক্ষণিক অবস্থান করে তদারকির জন্য প্রধান শিক্ষকের জন্য ক্যাম্পাসের পাশেই রয়েছে কোয়ার্টার। কিন্তু তিনি সেখানে থাকেন না। সেই বাসাটি ভাড়া দিয়েছেন অন্য একজন শিক্ষককে। তদারকির অভাবে প্রতিষ্ঠানের পুকুরটি স্থানীয়রা দখল করে নিজেরাই মাছের চাষ করছেন। বিদ্যালয়ের একটি কক্ষও স্থানীয় একটি সমিতি ব্যবহার করছে।
এ ব্যাপরে প্রধান শিক্ষক দেবব্রত দাশ বলেন, বাসভবনটি ব্যবহার অনুপযোগী হওয়ায় তিনি থাকেন না। তবে সরকারকে নিয়মিতই ভাড়া পরিশোধ করেন।