স্যার ফজলে হাসান আবেদের অনন্য কয়েকটি দিক

স্যার ফজলে হাসান আবেদ। প্রথম আলো ফাইল ছবি
স্যার ফজলে হাসান আবেদ। প্রথম আলো ফাইল ছবি

ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও ইমেরিটাস চেয়ার স্যার ফজলে হাসান আবেদ আর নেই। গতকাল শুক্রবার রাত ৮টা ২৮ মিনিটে রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে তিনি মারা যান। বাংলাদেশের ব্র্যাককে সারা বিশ্বে পরিচিত, সবচেয়ে বড় ও সম্মানিত এনজিও হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি।

মহান মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের তৃণমূলের মানুষের সেবা করতে গিয়ে ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেন ফজলে হাসান আবেদ। মাত্র এক লাখ কর্মী নিয়ে শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর ১১টি দেশের ১২০ মিলিয়ন মানুষকে বিভিন্ন সেবা দিয়ে চলেছে ব্র্যাক। বেসরকারি উন্নয়নে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া ফজলে হাসান আবেদ সমাজকর্মের জন্য স্যার উপাধি পাওয়া ছাড়াও বিশ্বের বহু সম্মানিত পুরস্কার পেয়ে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সম্মানিত করেছেন। তিনি মানুষ হিসেবে ছিলেন উদ্যমী, দারুণ সফল ও স্বপ্নদ্রষ্টা। জেনে নিন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা স্যার ফজলে হাসান আবেদের জীবনের কয়েকটি দিক:

একজন নির্মোহ মানুষ
স্যার ফজলে হাসান আবেদ ছিলেন একজন নির্মোহ মানুষ। তিনি চাইলে ব্যক্তিগতভাবে অনেক সম্পদের মালিক হতে পারতেন। কিন্তু তাঁর লক্ষ্য ছিল দরিদ্র মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। নিজের সম্পদের পেছনে ছুটলে তাঁর জীবনের ব্রত থেকে দূরে সরে যাবেন বলে নিজের সম্পদের দিকে ছোটেননি তিনি। একবার এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি ব্র্যাক থেকে বেতন নিই। কিন্তু আমার নিজের কিছু নেই। আমার নিজের বাড়ি নেই, ভাড়া করা ফ্ল্যাটে থাকি। যখন ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করি, তখনই নিজের জন্য কিছু করব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কারণ নিজের সম্পদ গোছানোর ব্যবসা করতে গেলে গরিবদের সাহায্য করতে পারব না।’

নারী-পুরুষের সমতা
স্যার ফজলে হাসান আবেদ মনে করতেন, নারী-পুরুষের সমতা ছাড়া এগোনো সম্ভব নয়। সামাজিক ক্ষমতায়নের জন্য সাধারণ মানুষকে জেন্ডার সমতা, নারী ও শিশুদের অধিকার—এসব বিষয়ে সচেতন করে তুলতে কাজ করেছেন তিনি। তাদের সামর্থ্য ও দক্ষতা বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন। তিনি বলেছেন, সামাজিক কর্মকাণ্ডগুলোতে যাতে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে তোলা যায়, তার ওপর বিশেষ জোর দিয়ে কাজ করেছেন তিনি।

নতুনদের প্রতি আস্থা
স্যার ফজলে হাসান আবেদ শুধু ব্র্যাক প্রতিষ্ঠা করেননি, এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম বেসরকারি সংস্থায় পরিণত করতে নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য নিয়ে যেমন কাজ করেছেন, তেমনি গড়ে তুলেছেন ব্র্যাক ব্যাংক, বিকাশ ও আড়ংয়ের মতো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। ব্র্যাকের এই প্রাণপুরুষ প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব তুলে দিয়েছেন নতুন নেতৃত্বের হাতে। বাংলাদেশে এ এক অনন্য নজির। প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ এবং বিশ্বের অন্য যে দেশগুলোতে আমরা কাজ করছি, সেখানে ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন ও উদ্ভাবনী সমাধান বের করতে হবে। আর এই কাজে তরুণ প্রজন্মের অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে।’ ২০০১ সালে ৬৫ বছর পূর্ণ করার পরই তিনি ঠিক করেন ব্র্যাকের নেতৃত্ব অন্যদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। তিনি তাঁর কথামতো তরুণ নেতৃত্বকে সামনে এনেছেন।

ভবিষ্যৎ স্বপ্নদ্রষ্টা
স্যার ফজলে হাসান আবেদ বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার ইতিবাচক স্বপ্ন দেখতেন। তাঁর বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তাঁর ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ‘আগামী ১০ বছরে আমরা আমাদের কাজের প্রভাব পৃথিবীর আরও বেশি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাই। ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের ২৫০ মিলিয়ন মানুষের কাছে ব্র্যাক যেন পৌঁছে যায়, সেটিই আমার প্রত্যাশা। আমি স্বপ্ন দেখি, ব্র্যাক ভবিষ্যতে আরও বড় হবে, নতুন উদ্ভাবন চালিয়ে যাবে এবং নতুন দিনের প্রয়োজনে নতুন সমাধান নিয়ে এগিয়ে আসবে।’

প্রযুক্তিবান্ধব
আধুনিক মনমানসিকতা ও প্রযুক্তিবান্ধব ব৵ক্তি হিসেবে অগ্রগণ্য ছিলেন স্যার ফজলে হাসান আবেদ। তিনি বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে প্রযুক্তির সমন্বয় করার বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবেই দেখেছেন সব সময়। গত বছরের মার্চে ক্রেডিট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরামের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রযুক্তিভিত্তিক আর্থিক সিস্টেমের দিকে যেতে হবে। কারণ আগামী এক দশকে ঋণ কার্যক্রম পুরোপুরি বদলে যাবে। ঋণের পরিমাণ ও পদ্ধতির বিষয়গুলো নির্ধারণ করে দেবে প্রযুক্তি। এতে সময় ও শ্রম বাঁচবে।

লক্ষ্যে অটল
মানুষের জীবনে লক্ষ্যতে অটল থাকতে পারলে এবং কঠোর পরিশ্রম করলে সফলতা আসে। তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্যার ফজলে হাসান। ২০১৫ সালে দারিদ্র্য বিমোচনে অবদান রাখায় ওয়ার্ল্ড ফুড পুরস্কার পান তিনি। ওই সময় তিনি নিজের লক্ষ্য পরিষ্কার করে বলেন, ‘বাংলাদেশে আমরা যা করেছি, তা একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থেকেই করেছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে দারিদ্র্যসীমার মধ্যে থেকে বের করে আনা। কারণ আমরা অনুভব করি যে, দারিদ্র্য অমানবিক রূপ নেয়। অতিদরিদ্র অবস্থা থেকে মানুষকে বের করা সম্ভব। এ জন্য বিশ্বের প্রতিটি দেশের অঙ্গীকার প্রয়োজন।’

ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ
একবার স্যার ফজলে হাসান আবেদকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ২০৩০ সাল নাগাদ কেমন বাংলাদেশ কল্পনা করেন? এর জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘আগামী এক দশকে বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষ কমে যাবে। তবে আমরা খুব বেশি ধনী হয়ে যাব না। আমাদের গড় আয় বেড়ে যাবে।’ বাংলাদেশকে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেখার জন্য পরিশ্রম করে গেছেন এই মহান ব্যক্তিটি। বাংলাদেশের উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের নিজস্ব উদ্ভাবনা ও অর্জিত অভিজ্ঞতা অন্য একটি দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কীভাবে কাজে লাগতে পারে, সে লক্ষ্যেও কাজ করে গেছেন আমৃত্যু।

তথ্যসূত্র: প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, ইউরাক্টিভ, গার্ডিয়ান।