জাদুঘরে সংসার

পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত জাদুঘরের কথা শুনেছেন আপনি। কিন্তু জাদুঘরে সংসার করার গল্প শুনেছেন কখনো? সম্ভবত শোনেননি। আর যদি শোনেন, অভিনব এ জাদুঘরের গল্পটি বাংলাদেশের; তখন আরও কিছুটা চমৎকৃত হবেন হয়তো। হ্যাঁ, গল্পটি বাংলাদেশের এবং কুড়িগ্রাম জেলার।

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ উত্তরবঙ্গের কুড়িগ্রাম জেলা। ১৯৭১ সালে পুরো দেশের মতো এ জেলাও ছিল যুদ্ধকবলিত। হাতিয়ার গণহত্যাসহ অনেকগুলো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের স্মৃতি ছড়িয়ে রয়েছে নদীবহুল এ জেলায়। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এবং আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ইতিহাস ধরে রাখার জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে কুড়িগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে ব্যাপারী পাড়ায় গড়ে উঠেছে ‘উত্তরবঙ্গ জাদুঘর’ নামের ব্যতিক্রমী এ জাদুঘর।

আইনজীবী এস এম আব্রাহাম লিংকন এই জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা। ১৪ শতাংশ জমির ওপর নিজের বসবাসের জন্য নির্মিত ‘লিংকনস ইন’ নামের বাড়িতে নিজের সংগ্রহ করা এবং বিভিন্ন মানুষের দেওয়া ঐতিহাসিক দলিল-দস্তাবেজ, বিভিন্ন নিদর্শন নিয়ে ‘মুক্তিযুদ্ধ, ইতিহাস এবং আঞ্চলিক ঐতিহ্যের সংগ্রহশালা’ হিসেবে তিনি ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন এ প্রতিষ্ঠান। এ কাজে এস এম আব্রাহাম লিংকনকে সহযোগিতা করেন তাঁর স্ত্রী অধ্যাপক নাজমুন্নাহার সুইটি। ২০১২ সাল থেকে আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার এক অনন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে যাত্রা শুরু করে ‘উত্তরবঙ্গ জাদুঘর’। প্রতি শনিবার সকাল সাড়ে নয়টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত জাদুঘরটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। তবে আগে থেকে জানিয়ে গেলে সপ্তাহের যেকোনো দিন দেখতে পাওয়া যায় উত্তরবঙ্গ জাদুঘর। দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকলেও এখানেই বসবাস করেন লিংকন-সুইটি দম্পতি। সম্ভবত বিশ্বের ইতিহাসে এটিই একমাত্র জাদুঘর, যেটি একই সঙ্গে সংগ্রহশালা এবং সংসার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

কুড়িগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে ব্যাপারী পাড়ায় প্রতিষ্ঠিত ‘উত্তরবঙ্গ জাদুঘর’। ছবি: লেখক
কুড়িগ্রাম শহরের উপকণ্ঠে ব্যাপারী পাড়ায় প্রতিষ্ঠিত ‘উত্তরবঙ্গ জাদুঘর’। ছবি: লেখক

যা আছে জাদুঘরে
কুড়িগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হলেও উত্তরবঙ্গ জাদুঘরের উদ্দেশ্য বৃহত্তর উত্তরবঙ্গের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসসহ আঞ্চলিক সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বিভিন্ন উপাদান সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা। এ জাদুঘরের সংগ্রহগুলোকে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। এর এক ভাগে আছে মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন এবং অন্য ভাগে আছে স্থানীয় ইতিহাসের বিভিন্ন নিদর্শন। এখানে রয়েছে খেতাবপ্রাপ্ত এবং খেতাবহীন কিছু মুক্তিযোদ্ধার সংক্ষিপ্ত জীবনী, যুদ্ধে ব্যবহৃত গুলি ও গ্রেনেডের বাক্স, যুদ্ধকালীন সময়ে কুড়িগ্রাম-ভারত ব্যাংকিং যোগাযোগের দলিলপত্র ও জ্বালিয়ে দেওয়া ঘরবাড়ির তালিকা। সংরক্ষিত আছে মুক্তিযুদ্ধের সময় ট্রেনিংয়ের জন্য ব্যবহৃত ডামি থ্রি নট থ্রি রাইফেল, পাকিস্তানি বাহিনীর ফেলে যাওয়া হেলমেট, আছে সেই সেলাই মেশিন; যা দিয়ে এই অঞ্চলে স্বাধীন বাংলায় প্রথম পতাকা তৈরি করা হয়েছিল। যুদ্ধ–পরবর্তী বঙ্গবন্ধু সরকারের পক্ষ থেকে শহীদ পরিবারগুলোকে দেওয়া আর্থিক সহায়তার প্রমাণপত্র, রৌমারী রণাঙ্গন থেকে প্রকাশিত হাতে লেখা অগ্রদূত পত্রিকার সব সংখ্যা, বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষর করা উত্তরবঙ্গের শহীদ জায়া ও জননীদের কাছে পাঠানো চেকের ছবি এবং চিঠি। আরও আছে রাজাকার বাহিনীতে যোগদানের তারিখ, নাম, ঠিকানাসহ ৫ হাজার ৮৬৫ জন রাজাকারের তালিকা। আছে স্থানীয় রাজাকার-দালালদের স্বহস্তে লেখা ক্ষমাপ্রার্থনার পত্র, রাজাকার বাহিনীতে যোগদানের আবেদনপত্র, শান্তি কমিটির সদস্যের তালিকাসহ সভার রেজল্যুশন এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তি দখলের আবেদনপত্র। রয়েছে স্থানীয় পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনীর গঠন করা শান্তি কমিটির সদস্যদের তালিকা ও কার্যক্রমের দলিল। এ ছাড়া রয়েছে বরেণ্য আলোকচিত্রী হারুন হাবীবের তোলা রৌমারী রণাঙ্গনের দুর্লভ কিছু আলোকচিত্র।

উত্তরবঙ্গ জাদুঘরের সামনে প্রতিষ্ঠাতা এস এম আব্রাহাম লিংকন। ছবি: লেখক
উত্তরবঙ্গ জাদুঘরের সামনে প্রতিষ্ঠাতা এস এম আব্রাহাম লিংকন। ছবি: লেখক

এ জাদুঘরে মুক্তিযুদ্ধের দলিল এবং বিভিন্ন স্মারক ছাড়াও রয়েছে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক উপাদান। আপনি যদি বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন বিলুপ্ত ছিটমহল বিষয়ে কিছু জানতে চান, তাহলেও যেতে পারেন উত্তরবঙ্গ জাদুঘরে। এখানে সংরক্ষিত আছে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের কফিন, চশমা, ব্যবহৃত সুগন্ধি, কুড়িগ্রামে শায়িত হওয়ার ইচ্ছাপত্রসহ কবির বিভিন্ন ব্যবহৃত জিনিসপত্র।

প্রতিষ্ঠার গল্প
আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও উত্তরবঙ্গ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পেছনে রয়েছে প্রতিষ্ঠাতা এস এম আব্রাহাম লিংকনের দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার গল্প। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক ছাত্র এবং রাকসুর সাবেক এজিএস ও রাবির সিনেট সদস্য এস এম আব্রাহাম লিংকন ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ফলে রাজনীতির সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন ইতিহাস–সচেতন। মুক্তিযুদ্ধে পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের অংশগ্রহণের কারণে শিক্ষাজীবন থেকে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিদর্শন সংগ্রহের প্রতি ঝোঁক ছিল তাঁর। এভাবেই একদিন বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেখার কাজে হাত দেন এস এম আব্রাহাম লিংকন। একসময় বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর বই মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস: রংপুর। এ বই লেখার জন্যই তিনি বিভিন্ন জায়গা থেকে সংগ্রহ করতে শুরু করেন উত্তর জনপদের মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন ঐতিহাসিক দলিলপত্র, স্মারক এবং সাংস্কৃতিক নিদর্শন। ঐতিহাসিক নিদর্শন সংগ্রহের কথা শুনে অনেকেই আগ্রহ করে তাঁদের কাছে থাকা বিভিন্ন জিনিসপত্র লিংকনের সংগ্রহশালায় দান করেন। প্রথম দিকে বসার ঘরে সাজিয়ে রাখা হতো নিদর্শনগুলো। কিন্তু ধীরে ধীরে সংগ্রহ করা নিদর্শন এবং দলিলপত্রের সংখ্যা বেড়ে গেলে এস এম আব্রাহাম লিংকনের স্ত্রী অধ্যাপক নাজমুন্নাহার সুইটি সেগুলো সংরক্ষণ করতে শুরু করেন পুরো বাড়ির বিভিন্ন জায়গায়। এভাবে লিংকনস ইন নামের দোতলা বাড়িটির ওপর এবং নিচতলার মোট সাতটি কক্ষের মধ্যে শয়নকক্ষ বাদে পুরো বাড়ি হয়ে ওঠে এক অভিনব সংগ্রহশালা।

দর্শনার্থী স্কুলের শিক্ষার্থী। ছবি: লেখক
দর্শনার্থী স্কুলের শিক্ষার্থী। ছবি: লেখক

এস এম আব্রাহাম লিংকন জানান, তাঁর একমাত্র সন্তান শাশ্বত গৌরব সিদ্ধার্থ অস্ট্রেলিয়ায় লেখাপড়া করেন। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই নিজেদের কাজের জন্য প্রায় সারা দিন বাড়ির বাইরে থাকেন। ফলে বাড়িটি খালিই থাকে। যেহেতু প্রচুর নিদর্শন সংগ্রহ করা হয়েছে, তাই সেগুলো সাধারণ মানুষের জন্য দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় উন্মুক্ত করে রাখায় তাঁদের কোনো সমস্যা হয় না; বরং এতে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন বয়স ও শ্রেণি-পেশার মানুষ মুক্তিযুদ্ধ এবং আঞ্চলিক ইতিহাসের বিভিন্ন নিদর্শন দেখার সুযোগ পান। এই দম্পতির অবর্তমানে বাড়িটি দেখাশোনার দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন একজন পুরুষ এবং দুজন নারী কর্মী। এ ছাড়া তাঁদের প্রতিবেশীরা বিভিন্নভাবে তাঁদের সহায়তা করে থাকেন।

এস এম আব্রাহাম লিংকন বলেন, ‘এই জাদুঘরে যেমন গবেষকেরা আসছেন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধকেন্দ্রিক নানান ধরনের বিচারের অনুষঙ্গ তদন্তের স্বার্থে তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তাগণও অনুসন্ধানে আসছেন। আমরা তাঁদের তথ্য সহায়তা প্রদান করছি সাধ্যমতো।’

একটি শহীদ পরিবারকে লিখিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত চেক ও চিঠি। ছবি: লেখক
একটি শহীদ পরিবারকে লিখিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত চেক ও চিঠি। ছবি: লেখক

দর্শনে গুণীজন
ইতিমধ্যে সংগ্রহশালাটি ঘুরে দেখেছেন অনেক বরেণ্য ব্যক্তি। এখানে এসেছিলেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক, বিচারপতি ভবানী প্রসাদ সিংহ, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১–এর সাবেক চেয়ারম্যান বিচারপতি ফজলে কবির, চলচ্চিত্রনির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল, শিক্ষক নাহিদ হাসানসহ অনেকে। কবি সৈয়দ শামসুল হক ২০১৫ সালের ১৩ নভেম্বর মাসে উত্তরবঙ্গ জাদুঘর পরিদর্শন করেছিলেন।

ভবিষ্যৎ
‘আমি আমার মতো করে শুরু করেছি। বাকিটা আপনাদের ব্যাপার। এখানকার সবকিছু রাষ্ট্রের সম্পদ বলে বিশ্বাস করি।’ উত্তরবঙ্গ জাদুঘরের ভবিষ্যৎ জানতে চাইলে এভাবেই উত্তর দেন এস এম আব্রাহাম লিংকন। তাঁর এ কথায় আমরাও ভাবতে বসি জাদুঘরটির ভবিষ্যৎ নিয়ে। জাদুঘরটিতে ইতিহাসের অনেক সাক্ষ্য রয়েছে। যে সাক্ষ্যগুলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুধু নয়, আমাদের জাতীয় ইতিহাসের জন্য মূল্যবান সম্পদ। এ সম্পদ বিনষ্ট হলে ক্ষতি হবে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের। এস এম আব্রাহাম লিংকন তাঁর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় ব্যয় করেছেন এসব সংগ্রহের জন্য। রাজি আছেন নিজের ২০–২৫ শতাংশ জমি জাদুঘরের জন্য ছেড়ে দিতে। কিন্তু তারপর? প্রতিটি নিদর্শন বৈজ্ঞানিকভাবে সংরক্ষণ করতে প্রয়োজন বিপুল আয়োজন। এই আয়োজনের সামর্থ্য এককভাবে এস এম আব্রাহাম লিংকনের নেই। ‘বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি’ হিসেবে আমাদের যে বিপুল খ্যাতি, ‘উত্তরবঙ্গ জাদুঘর’কে ভুলে গিয়ে আমরা কি আরেকবার প্রমাণ করব সেটা?

লেখক: গণমাধ্যমকর্মী