তরুণেরা কী ভাবছেন, কী করছেন

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

জাতিসংঘের সংজ্ঞায় যাঁদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে, তাঁদেরই তরুণ বলা হয়। বিশ্বব্যাপী এই তরুণের সংখ্যা এখন ১৮০ কোটি। আবার ১৬ কোটির বেশি জনসংখ্যার বাংলাদেশে তরুণের সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ। বাংলাদেশে নির্ভরশীল মানুষের তুলনায় কর্মক্ষম জনসংখ্যার পরিমাণ বেশি। এই সুবিধা থাকবে ২০৪০ সাল পর্যন্ত।

এ পরিস্থিতিতে এই তরুণ অংশের চিন্তাভাবনা, জীবনযাপন, ভবিষ্যতের লক্ষ্য জানা বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তরুণদের এই মনোভাব জানতে প্রথম আলো বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ওআরজি–কোয়েস্টের মাধ্যমে দ্বিতীয়বারের মতো একটি দীর্ঘমেয়াদি জরিপ চালায়।

‘তরুণদের আচরণ ও মনোভাব সমীক্ষা ২০১৯’ শীর্ষক জরিপে দেশের সার্বিক পরিস্থিতির পাশাপাশি নিজেদের উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক মূল্যবোধ, নৈতিকতা, ধর্ম, জঙ্গিবাদ এবং মাদকের মতো বিষয় নিয়ে তরুণদের মতামত জানতে চাওয়া হয়। তরুণেরা কী ভাবেন, অবসরে কী করেন, বিনোদনের জন্য কোন মাধ্যম পছন্দ করেন—এসব বিষয়ও জরিপের বিষয়বস্তু ছিল। বিশ্বায়ন, ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তরুণদের বিশ্বাস, জ্ঞান ও দৃষ্টিভঙ্গিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলছে, সেটিও এই জরিপে তুলে আনা হয়েছে।

প্রথম আলো প্রথমবার জরিপটি করেছিল ২০১৭ সালে। তখনই ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল, প্রথমবারের জরিপে উঠে আসা তরুণদের মতামত বিষয়ে ধারাবাহিকভাবে জরিপ চালাবে প্রথম আলো। এতে সময়ের পরিবর্তনে তরুণদের চিন্তাভাবনা ও মনোজগতে কী পরিবর্তন আসছে, সেটিও উঠে আসবে। প্রথম আলো তারুণ্য জরিপ-২০১৯ সেই ঘোষণারই ফল।

এবারের জরিপেও সারা দেশের ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী ১ হাজার ২০০ তরুণের মতামত নেওয়া হয়েছে। জরিপটি প্রতিনিধিত্বশীল করতে দেশের সব বিভাগ, শহর ও গ্রামের তরুণদের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে। এ ছাড়া লিঙ্গ, বয়স, পেশা, শিক্ষাগত অবস্থান, বৈবাহিক সম্পর্ক, ইন্টারনেট ব্যবহারের মতো বিষয়গুলো মতামত সংগ্রহে বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। জরিপের মতামত সংগ্রহে মুখোমুখি সাক্ষাৎকার পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে। প্রশ্নমালা তৈরিতে করা হয়েছে দলভিত্তিক আলোচনা (ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন)।

২০১৭ সালের সঙ্গে এবারেরটির বড় পার্থক্য হলো, পরিমাণগত জরিপের পাশাপাশি গুণগত জরিপও করা হয়েছে। জরিপের প্রাপ্ত ফলাফল নিয়ে ২০ জনের সঙ্গে গভীর বিশ্লেষণধর্মী সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ৬ জন বিশেষজ্ঞ, ৭ জন পুরুষ এবং ৭ জন নারী। পুরো জরিপ করা হয়েছে দৈবচয়ন ভিত্তিতে। ১ হাজার ২০০ জনের মতামত সারা দেশের তরুণদের মনোভাব কতটা প্রতিফলিত করতে পারে? ওআরজি–কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঞ্জুরুল হক এ নিয়ে বলেন, ‘জনমতের আন্দাজ পাওয়ার জন্য এ সংখ্যা সন্তোষজনক। দেশের আদমশুমারি অনুযায়ী মানুষের ভৌগোলিক অবস্থান, লিঙ্গভেদ, জাতি ও বয়সের অনুপাতে আমরা উত্তরদাতা নির্বাচন করেছি। এতে মানুষের প্রতিনিধিত্বশীল মতামত সঠিকভাবে উঠে এসেছে। বিচ্যুতির হার ধরা হয়েছে কমবেশি ২ দশমিক ৮৩ শতাংশ। কমবেশি ৩-এর মধ্যে থাকলেই জনমত জরিপকে সাধারণত যথাযথ বলে ধরে নেওয়া হয়। সে জন্য ১,১০০ থেকে ১,২০০ উত্তরদাতাই যথেষ্ট।’

বাংলাদেশে যেহেতু নারী-পুরুষের অনুপাত সমান, জরিপেও এই বিষয়ে ভারসাম্য পুরোপুরি রক্ষা করা হয়েছে। জরিপে অংশ নেওয়াদের মধ্যে ছেলে ও মেয়ের সংখ্যা ছিল সমান। সব বিভাগের তরুণদের মতামত জরিপে নেওয়া হলেও সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে ঢাকা বিভাগ। মোট মতামতদাতাদের ২৫ দশমিক ৬ শতাংশই এ বিভাগের তরুণ। এর পরের স্থানে আছে চট্টগ্রাম বিভাগ। এই বিভাগের ২১ দশমিক ২ শতাংশ তরুণের মতামত জরিপে স্থান পেয়েছে। জরিপে রাজশাহী বিভাগে ১৪ দশমিক ১ শতাংশ, খুলনা বিভাগে ১১ দশমিক ২ শতাংশ, রংপুর বিভাগের প্রতিনিধিত্ব ছিল ৯ দশমিক ৬ শতাংশ। সিলেট, বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগ থেকে বাকি মতামত নেওয়া হয়েছে।

উত্তরদাতাদের মধ্যে ৩৫ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণ এখন পড়ালেখা করেন, বাকি ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ পড়ালেখার বাইরে আছেন। আবার এসব তরুণের মধ্যে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ, ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী ৩২ দশমিক ১ শতাংশ এবং ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী ৩৭ দশমিক ১ শতাংশ।

জরিপে মতামত দেওয়া ৬১ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণ নিয়মিত ইন্টারনেট ব্যবহার করেন বা ব্যবহারের সুযোগ পান। যদিও উত্তরদাতা ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারে বড় ধরনের পার্থক্য আছে। মতামত দেওয়া তরুণদের মধ্যে ছেলেদের ইন্টারনেট ব্যবহারের হার ৮৩ দশমিক ৫ শতাংশ।

মতামত দেওয়া তরুণদের মধ্যে এসএসসি, এইচএসসি বা ডিপ্লোমা পর্যায়ে পড়ালেখা করেছেন ৪০ দশমিক ৮ শতাংশ, মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত পড়ালেখা করা তরুণ আছেন ৩৫ দশমিক ৩ শতাংশ, ১৫ শতাংশ প্রাথমিক পর্যায় পর্যন্ত পড়েছেন আর স্নাতক ও উচ্চতর পর্যায়ের শিক্ষার্থী আছেন ৬ দশমিক ৯ শতাংশ। উত্তরদাতাদের মাত্র ২ শতাংশ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা পাননি।

পেশার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি ৩৫ দশমিক ৫ শতাংশ ছিলেন শিক্ষার্থী। গৃহিণী ছিলেন ৩২ দশমিক ৫ শতাংশ, দক্ষ শ্রমিক ৭ দশমিক ৭ শতাংশ, বেসরকারি খাতে কাজ করেন ৫ দশমিক ৮ শতাংশ, ব্যবসায়ী ৪ দশমিক ৫ শতাংশ, কৃষিকাজে জড়িত ৩ দশমিক ৮ শতাংশ এবং অদক্ষ শ্রমিক ২ দশমিক ৬ শতাংশ।

জরিপটি নিয়ে ওআরজি-কোয়েস্ট রিসার্চ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মঞ্জুরুল হক বলেন, এটা প্রথম আলোর একটি ভালো উদ্যোগ। ২০১৭ সালে প্রথমবারের মতো জরিপটি করা হয়। এবার দ্বিতীয়বারের মতো করা হয়েছে। তরুণদের চিন্তাভাবনা, চাওয়া-পাওয়া সময়ের সঙ্গে কীভাবে বদলে যাচ্ছে, সেটি অনুসরণ করতে প্রতি দুই বছর অন্তর এই জরিপ চালিয়ে যাওয়া হবে।

মঞ্জুরুল হক আরও বলেন, ‘দেশের সবচেয়ে বড় কর্মক্ষম গোষ্ঠী তরুণেরা এবং ভবিষ্যতের দেশ পরিচালনার নেতৃত্বও দেবেন তাঁরা। দেশে তরুণদের নিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা করার নজির খুব একটা দেখা যায় না। অন্যান্য দেশে এ ধরনের গবেষণা মূলত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করে থাকে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভবিষ্যতে এমন গবেষণায় এগিয়ে আসবে—এই প্রত্যাশা করছি।’