অনলাইনে সচেতনতা জরুরি

প্রযুক্তির প্রসারে বদলে যাচ্ছে অপরাধের ধরন। দিন দিন বাড়ছে সাইবার অপরাধ। আর এই অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে তরুণের একটি অংশ। আবার ভুক্তভোগীরাও মূলত তরুণ। বিশেষ করে নারীরা সাইবার অপরাধের বেশি শিকার হচ্ছেন। তাই ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি। না হলে বিপদে পড়ার ঝুঁকি বাড়বে।

‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীর নিরাপত্তা: বাস্তবতা ও করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্টজনদের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে এসেছে। গতকাল রোববার প্রথম আলো কার্যালয়ে এই গোলটেবিল অনুষ্ঠিত হয়।

প্রথম আলোর আয়োজনে এই গোলটেবিল বৈঠকে সহযোগিতা দেয় অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে তথ্য ও প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া আন্তর্জাতিক প্রচারাভিযান ‘টেকব্যাক দ্য টেক’ এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিডিওএসএন (বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক)।

আলোচকেরা আরও বলেন, ফেসবুককে ঘিরে তৈরি হওয়া আসক্তির কারণে তরুণেরা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন। এমনকি তাঁদের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে বন্ধুদের তালিকায় আত্মীয়স্বজন দূরের কথা বাবা-মাও থাকছেন না। ফলে তরুণেরা ফেসবুকে কী করছেন, কোনো ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন কি না, তা জানা যাচ্ছে না। আবার অনেকে ব্যক্তিগত বিষয়ও ফেসবুকে অপরিচিত মানুষের সঙ্গে শেয়ার করছেন, যা বিপদ ডেকে আনতে পারে। ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহারে তরুণ–তরুণীদের সচেতন আচরণ করার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।

নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন মাল্টিসেক্টরাল কার্যক্রমের পরিচালক আবুল হোসেন বলেন, প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে ধরনের অপরাধ হচ্ছে, তা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে সমাজে নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ ধরনের অপরাধ দমনে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলের একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। অপরাধ সংঘটিত হলে বা হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হলে দ্রুত সরকারের জাতীয় হেল্পলাইন সেন্টার ১০৯–এ ফোন করলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রয়োজনীয় সহায়তা পাওয়া যাবে বলে তিনি জানান।

২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত সাইবার অপরাধের কারণে তিন শতাধিক মামলা হয়েছে বলে জানান ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম ডিভিশনের সিনিয়র সহকারী কমিশনার সায়েদ নাসিরুল্লাহ। তিনি জানান, সাইবার অপরাধের অভিযোগে গত তিন বছরে বিভিন্ন থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে তিন হাজারের বেশি। ফেসবুককে কেন্দ্র করেই বেশির ভাগ অপরাধ হয়েছে। তিনি বলেন, সাইবার অপরাধের প্ল্যাটফর্ম আন্তর্জাতিক হওয়ায় অনেক সময় অপরাধী শনাক্ত করা বড় চ্যালেঞ্জ। এ ধরনের অপরাধ রোধে ফেসবুকে কী শেয়ার করা যায়, কী যায় না, সে বিষয়ে সচেতনতা জরুরি।

সন্তান লালন-পালনে অভিভাবকেরা ছেলে ও মেয়েদের মধ্যে বৈষম্য করেন বলে গোলটেবিল আলোচনায় মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবটিকস অ্যান্ড মেকাট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল। তিনি বলেন, নিরাপদ থাকতে পরিবার থেকে মেয়েকে যেমন সচেতন করা হয়, একইভাবে ছেলে বলতে হবে ‘তোমার কারণে যেন কোনো মেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়’।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে সচেতনতা জরুরি উল্লেখ করে লাফিফা জামাল বলেন, মনে রাখতে হবে, খুব কাছের মানুষ হলেও সবকিছু শেয়ার করা যাবে না। কারণ সম্পর্কের ধরন বদলে গেলে প্রিয় ব্যক্তিই ক্ষতির কারণ হতে পারে।

সাইবার অপরাধের শিকার এক তরুণী গোলটেবিল বৈঠকে নিজের অভিজ্ঞতার কথা শোনান। তিনি বলেন, আইনি সহায়তা নিতে গিয়েও পুলিশের সহযোগিতা পাননি, বরং কটুকথা শুনতে হয়েছে তাঁকে। তবে তিনি থেমে থাকেননি শেষ পর্যন্ত, প্রতিবাদ করে গেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন বলেন, প্রযুক্তি সমাজে অপরাধের একটি নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। যে সমস্যার শিকার হয়ে মেয়েরা পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছেন, আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। সমস্যা সমাধানে মেয়েদের মানসিকভাবে শক্তিশালী হতে হবে।

কনটেসা সলিউশন অ্যান্ড কনসালট্যান্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লুৎফর রহমান বলেন, নারীকে হয়রানি ও বুলিংয়ের ঘটনা আগেও ছিল। কিন্তু এখন এর ব্যাপকতা বেড়েছে। এ অপরাধ রোধে যেখানে সুযোগ আসবে, সেখানেই এ নিয়ে কথা বলতে হবে। মুঠোফোনে বা অনলাইনে কাউকে কোনো খারাপ কনটেন্ট (মেসেজ, ছবি বা ভিডিও) পাঠিয়ে পরে তা মুছে ফেললেও এটি পুনরুদ্ধার করা যায়। এই তথ্য সবাইকে জানানোটাও জরুরি। তাতে অপরাধপ্রবণতা কিছুটা হলেও কমে আসতে পারে।

সাইবার ক্রাইম রোধে গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে বলেন প্রথম আলো অনলাইনের ইংরেজি সংস্করণের প্রধান আয়েশা কবির। তিনি বলেন, এ ধরনের সমস্যা হলে কাকে জানাতে হবে, প্রতিকারের জন্য কোথায় যেতে হবে, সে পরামর্শও সংবাদে থাকতে হবে।

টেকব্যাক দ্য টেকের সমন্বয়কারী মাহবুবা সুলতানা বলেন, অনলাইনে আগ্রাসী ভূমিকার শিকার হন নারীরা। তাই নারীরা কীভাবে নিরাপদ থেকে ইন্টারনেট ব্যবহার করবেন, সে বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে।

গোলটেবিল বৈঠকে সূচনা বক্তব্যে বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সাধারণ সম্পাদক মুনির হাসান বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিকাশের সঙ্গে অপরাধও বাড়ছে। বাংলাদেশে এটা এখন আতঙ্কের ব্যাপার।

গোলটেবিল বৈঠকের সঞ্চালক ছিলেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।