আলগা হচ্ছে পারিবারিক বন্ধন

‘এই কূলে আমি আর ওই কূলে তুমি/ মাঝখানে নদী ওই বয়ে চলে যায়...’। কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দের এই বিখ্যাত গান এখন বাংলাদেশের পরিবারগুলোর জন্য বাস্তবতা। পরিবারগুলো এখন পরিণত হয়েছে বিচ্ছিন্ন দ্বীপে। মা-বাবার কাছ থেকে ক্রমশ দূরে চলে যাচ্ছেন সন্তানেরা। এক পরিবারে থেকেও মা-বাবা ও সন্তানেরা দিন কাটাচ্ছেন যে যাঁর মতো করে। পারিবারিক বন্ধন আর আগের মতো দৃঢ় নয়, হয়ে পড়েছে বড়ই ঠুনকো।

এ দেশের তরুণেরা বলছেন, পরিবারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া বিষয়েই তাঁদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেশি। মা-বাবার সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব বাড়ছে। মা-বাবা দুজনেই আয়-রোজগারে সম্পৃক্ত হওয়া কারণেই কি দূরত্ব কমছে না, এ প্রশ্নটাও এসেছে জরিপে। সব মিলিয়ে মা-বাবা ও পরিবারের সঙ্গে মানিয়ে চলার বিষয়টি নিয়ে তরুণেরা আগের মতোই বেজায় উদ্বিগ্ন।

প্রথম আলোর তারুণ্য জরিপ-১৯-তে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সারা দেশের ১৫ থেকে ৩০ বছর বয়সী ১ হাজার ২০০ তরুণের মতামতের ভিত্তিতে জরিপটি তৈরি করা হয়েছে।

জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের কাছে প্রশ্ন ছিল, কোন তিনটি বিষয় নিয়ে তাঁদের উদ্বেগ সবচেয়ে বেশি। তরুণেরা সবচেয়ে বেশি বলেছেন পরিবারের সঙ্গে খাপ খাওয়ার বিষয়টির কথা। যেমন ৪৫ দশমিক ৪ শতাংশ তরুণ পরিবারের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে না পারাকেই তাঁদের প্রধান উদ্বেগ বলে মনে করেন। জীবনের লক্ষ্য, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা, চাকরিবাকরি বা পড়াশোনা—কোনোটাতেই তাঁরা এর সমান উদ্বেগের জায়গা বলে মনে করেন না।

তবে দুই বছরের ব্যবধানে এ ক্ষেত্রে উদ্বেগের মাত্রা কিছুটা কমেছে। যেমন প্রথম আলোর করা ২০১৭ সালের জরিপে তরুণদের কাছে একই প্রশ্ন করা হয়েছিল। তখন ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণের সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ ছিল পরিবার নিয়ে।

সন্তানদের সঙ্গে মা-বাবার সম্পর্ক
জরিপে অংশ নিয়ে ১০ জনে প্রায় ৮ জন মনে করেন, মা-বাবার সঙ্গে সন্তানদের দূরত্ব বাড়ছে। তরুণদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল কেন এই দূরত্ব এবং এতে কি পারিবারিক বন্ধনও আলগা হয়ে যাচ্ছে। একই ধরনের প্রশ্ন করা হয়েছিল ২০১৭ সালের জরিপেও। দেখা যাচ্ছে, তরুণদের মনোভাবের খুব বড় কোনো পরিবর্তন আসেনি। যেমন ২০১৭ সালে ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ তরুণ সম্পূর্ণভাবে একমত ছিলেন যে সন্তানদের সঙ্গে মা-বাবার দূরত্ব বাড়ছে। ২০১৯ সালে এসে দেখা যাচ্ছে, এ রকম মনে করার সংখ্যাটা সামান্য বেড়েছে। এখন ৪৮ দশমিক ৯ শতাংশ তরুণই এমনটা মনে করেন। আর এ প্রশ্নে কিছুটা সম্মত ২৯ দশমিক ২ শতাংশ তরুণ, ২০১৭ সালে যা ছিল ৩৮ শতাংশ। আর মা-বাবার সঙ্গে সন্তানদের দূরত্ব বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে একমত নন এক-পঞ্চমাংশ তরুণ।

জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের সিংহভাগ অবশ্য একটি বিষয়ে বয়স-লিঙ্গ-শিক্ষানির্বিশেষে একমত হয়েছেন। যেমন জরিপে অংশ নিয়ে তরুণেরা বলছেন, মা-বাবা দুজনেই অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে, অর্থাৎ চাকরি বা ব্যবসায় অংশ নেওয়ায় দূরত্ব বাড়ছে বেশি। ৭৮ শতাংশ তরুণের মত এটি। তাঁরা মনে করেন, এই কারণে মা-বাবার কাছ থেকে সন্তানেরা দূরে সরে যান এবং তার ফলস্বরূপ পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ছে।

দুই বছর আগের করা জরিপে মা-বাবার আয়-রোজগারে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়টিকে আরও বেশি তরুণ কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। ওই সময় ৮৫ শতাংশের বেশি তরুণ একে মা-বাবার সঙ্গে সন্তানদের দূরত্ব বৃদ্ধির কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন।

পরিবারগুলোয় যখন এমন চিত্র, তখন সমাজও এর কারণে ভুগছে। জরিপে তরুণেরা বলেছেন, দেশে সামাজিক বন্ধন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের ৭৮ দশমিক ৩ শতাংশের মত এটি। তবে ২০১৭ সালের জরিপে আরও বেশি তরুণ এ ব্যাপারে একমত হয়েছিলেন। তখন এর হার ছিল ৮৫ দশমিক ৩ শতাংশ। 

সবাই যা বলছেন
পরিবার নিয়ে গুণগত জরিপেও দেখা গেছে একই চিত্র। গুণগত জরিপে ২০ জনের দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ছয়জন ছিলেন বিশেষজ্ঞ আর সাতজন পুরুষ ও সাতজন নারী। তাঁদের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, দেশের তরুণেরা কি আগের তুলনায় বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছেন, তাঁরা কি অনলাইনে খুব বেশি অনুৎপাদনশীল সময় কাটাচ্ছেন এবং ক্রমশ মা-বাবার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।

তরুণেরা এ বিষয়ে বলছেন, সন্তানেরা মা-বাবার কাছ থেকে মনোযোগ ও সময় পাচ্ছেন না। বিশেষ করে মা-বাবা উভয়েই কর্মজীবী হলে এই সংকট আরও তীব্র হয়। বাবা-মায়েরাও সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে (ফেসবুক, ইউটিউব প্রভৃতি) আসক্ত হয়ে পড়ছেন। কিছু ক্ষেত্রে সন্তানকে টেলিভিশনে কার্টুন সিরিজ দেখতে বসিয়ে বাবা-মায়েরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটাচ্ছেন।

আবার জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের একাংশ বলছেন, বাবা-মায়েরা কিছু ক্ষেত্রে সন্তানদের ওপর শৃঙ্খলার বিষয়টি চাপিয়ে দিচ্ছেন এবং এ বিষয়ে অতিরিক্ত কঠোরতা দেখাচ্ছেন। তাঁরা সন্তানদের ওপর অতিরিক্ত চাপ দিচ্ছেন পড়াশোনার বিষয়েও। কিন্তু সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলার বিষয়ে মা-বাবার আগ্রহ কম। ফলে সন্তানদের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব বেড়েই চলেছে। আর এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে সন্তানদের নৈতিক স্খলন হচ্ছে, তাঁরা আটকে পড়ছেন মাদক ও হতাশার ফাঁদে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মা-বাবা ও সন্তানদের মধ্যকার এই ক্রমবর্ধমান দূরত্ব কমাতে এগিয়ে আসতে হবে মা-বাবাকেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বদলে সন্তানদের বেশি বেশি সময় দিতে হবে। গড়ে তুলতে হবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। মা-বাবার দেখাদেখি সন্তানেরাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পড়তে পারে। এসব ক্ষেত্রে সন্তানদের আচরণে পরিবর্তন আসছে কি না, তা খেয়াল রাখতে হবে। ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে আত্মনিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার বিষয়টিও সন্তানদের শেখাতে হবে মা-বাবাকেই।