নুরুলদের ওপর হামলার প্রমাণ মুছে দিতে ফুটেজ গায়েব

গ্রেপ্তার মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের তিন নেতাকে আদালতে আনা হয়। গতকাল সিএমএম আদালতের সামনে।  প্রথম আলো
গ্রেপ্তার মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের তিন নেতাকে আদালতে আনা হয়। গতকাল সিএমএম আদালতের সামনে। প্রথম আলো

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ভবনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজের সন্ধান পাওয়া যায়নি। ফুটেজটি কে বা কারা সরিয়েছে, সেই প্রশ্নের উত্তরও জানা নেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। ডাকসুর সহসভাপতি (ভিপি) নুরুল হক ও তাঁর সহযোগীদের ওপর ছাত্রলীগ ও মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতা-কর্মীদের হামলার পুরো ঘটনার ভিডিও চিত্র রয়েছে ওই ফুটেজে। ডাকসু ভিপির অভিযোগ, হামলার প্রমাণ মুছে ফেলতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা ফুটেজ সরিয়ে ফেলেছেন।

এদিকে এই হামলার ঘটনায় গ্রেপ্তার মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের তিন নেতাকে গতকাল মঙ্গলবার তিন দিন করে রিমান্ডে নেওয়ার অনুমতি দিয়েছেন আদালত। তাঁরা হলেন মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক আল মামুন, দপ্তর সম্পাদক মেহেদি হাসান এবং এই অংশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ইয়াসির আরাফাত। মামুন ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় মুক্তিযুদ্ধ ও গবেষণাবিষয়ক উপসম্পাদক এবং ইয়াসির আরাফাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।

হামলার দুই দিনের মাথায় সোমবার দিবাগত রাত পৌনে একটায় পুলিশ বাদী হয়ে এ ঘটনায় শাহবাগ থানায় মামলা করে। মামলায় আসামি করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের একাংশের সভাপতি আমিনুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক আল মামুন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনেট মাহমুদ, সাধারণ সম্পাদক ইয়াসির আরাফাত, এফ রহমান হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ইমরান সরকার, জসীমউদ্‌দীন হল শাখার সাধারণ সম্পাদক ইয়াদ আল রিয়াদ, জিয়া হলের সভাপতি তৌহিদুল ইসলাম মাহিম এবং মাহবুব হাসানকে। মাহবুব হাসানের পরিচয় জানা যায়নি। আর গ্রেপ্তার মেহেদি হাসান এজাহারভুক্ত আসামি নন। হামলায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও অংশ নেন। কিন্তু মামলার এজাহারে হামলার জন্য শুধু মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতা-কর্মীদের দায়ী করা হয়েছে। ছাত্রলীগের বিষয়ে কিছু উল্লেখ করা হয়নি।

>

হামলায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাও অংশ নেন। পুলিশের মামলায় তাঁদের নাম নেই।

পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করার পর ডাকসু ভিপি নুরুল হক গতকাল সন্ধ্যায় শাহবাগ থানায় একটি অভিযোগপত্র দিয়েছেন। সেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সঞ্জিত চন্দ্র দাস, সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনসহ ৩৭ জন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করেছেন তিনি। তাঁর দাবি, এই ছাত্রলীগ নেতারা হামলায় প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছেন এবং তাঁর সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ২০টি মুঠোফোন ছিনতাই ও তাঁদের পকেটে থাকা ১৫ হাজার টাকা চুরি করে নিয়ে গেছেন।

শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ডাকসু ভিপির লিখিত অভিযোগ তাঁরা পেয়েছেন। মূল মামলার সঙ্গে যুক্ত করে আজ বুধবার তা আদালতে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। মামলার আসামি হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘আইনের আশ্রয় নেওয়ায় ভিপি নুরুল হককে লাল গোলাপ শুভেচ্ছা। নাটকবাজ ভিপি থেকে দুর্নীতিবাজ ভিপি এবং সবশেষ তিনি মামলাবাজ ভিপিতে পরিণত হলেন।’

অভিযোগ ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে

ডাকসু ভিপি নুরুল হক ও তাঁর সহযোগীদের ওপর হামলা হয় গত রোববার দুপুরে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, দুপুর ১২টায় রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি শেষ করে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতা-কর্মীরা যখন মধুর ক্যানটিনে যাচ্ছিলেন, তখনই হামলার সূত্রপাত হয়। সময় তখন দুপুর ১২টা ৩৫ থেকে ৪০ মিনিট। এরপর ২০-২৫ মিনিট মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতা-কর্মী ও বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা-কর্মীদের মধ্যে পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটে। ডাকসুর কর্মকর্তারা তখন লোহার ফটকে তালা লাগিয়ে দেন। নুরুল হক ও তাঁর সহযোগীরা ডাকসু ভবনের ভেতরে (দোতলা) এবং মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের নেতা-কর্মীরা ভবনের নিচে অবস্থান নেন।

ঘটনাস্থল থেকে তোলা ছবির সময় অনুযায়ী, বেলা ১টা ৫ মিনিটে ঘটনাস্থলে আসেন সঞ্জিত চন্দ্র দাস ও সাদ্দাম হোসেন। এ সময় ডাকসু কর্মকর্তারা লোহার ফটকের তালা খুলে দেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্য অনুযায়ী, ছাত্রলীগের শতাধিক নেতা-কর্মীকে সঙ্গে নিয়ে সঞ্জিত ও সাদ্দাম ভবনে ঢোকেন। একপর্যায়ে তাঁরা ভিপি ও তাঁর সহযোগীদের ওপর চড়াও হন। বেলা ১টা ২৩ মিনিটে হাজির হন প্রক্টর ও সহকারী প্রক্টররা। নুরুল হক ও তাঁর সহযোগীরা তখন ভিপির কক্ষে ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে অবস্থান করছিলেন। পরে তাঁদের অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

ডাকসু ভবনের বাইরে এবং ভেতরে মিলিয়ে মোট ৯টি ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা আছে। ক্যামেরার ফুটেজগুলো ধারণ করা হতো ডাকসুর সিনিয়র অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার আবুল কালাম আজাদের কক্ষে। সেই কক্ষে একটি মনিটর এবং একটি সিপিইউ ছিল। টানা তিন দিন ফুটেজ সংরক্ষণ হতো। এরপর স্বয়ংক্রিয়ভাবে তা মুছে যেত। ফুটেজ খোয়া যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলছেন, বেলা ১টা ৫ মিনিটে সাদ্দাম ও সঞ্জিত যখন ডাকসু ভবনে আসেন, তখন তিনি তাঁর কক্ষে তালা লাগিয়ে প্রক্টরের কাছে ঘটনা জানাতে যান। সেখান থেকে যান ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ডিন ও ডাকসুর কোষাধ্যক্ষ শিবলী রুবাইয়াতুল ইসলামের কাছে। তাঁকে কার্যালয়ে না পেয়ে তিনি যখন ফেরেন, তখনো নুরুলদের হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। এসে দেখেন তাঁর কক্ষের তালা ভাঙা এবং মনিটর ও সিপিইউ নেই। বিষয়টি তিনি সঙ্গে সঙ্গে প্রক্টরকে জানান। প্রক্টর বিষয়টি ডাকসুর কোষাধ্যক্ষকে জানাতে বলেন। কিন্তু কোষাধ্যক্ষ ফোন ধরেন রাত আটটায়।

নুরুল হক গতকাল বলেন, তিনি ও তাঁর সহযোগীরা ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের হামলায় কোণঠাসা ছিলেন। আহত অবস্থায় একে একে ভবন থেকে তাঁরা বেরিয়েছেন সবার সামনেই। হামলার প্রমাণ মুছে ফেলতে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সরিয়ে ফেলেছেন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হামলার সময় ডাকসু ভবনে পাঁচজন কর্মচারী উপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে তিনজন চুক্তিভিত্তিক কাজ করছেন। বাকি দুজনের একজন অফিস সহকারী, অন্যজন ক্লিনার। একটি সূত্র বলছে, চাকরি স্থায়ী না হওয়া তিনজনের একজন সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সরিয়ে ফেলতে ছাত্রলীগ নেতাদের সহায়তা করেছেন।

সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান গতকাল সাংবাদিকদের বলেছেন, তাঁরা এ বিষয়ে পুলিশের সাহায্য চেয়েছেন। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।

ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব করেছেন—এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বিষয়টি সরাসরি অস্বীকার করেন।

সংহতি সমাবেশ, বিক্ষোভ

ভিপি নুরুল ও তাঁর সহযোগীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে গতকাল বিকেল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সন্ত্রাসবিরোধী ছাত্র ঐক্যের ব্যানারে সংহতি সমাবেশ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা৷ সমাবেশে অংশ নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, আইনজীবী, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান। হামলাকারীদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান তাঁরা৷ বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরের পদত্যাগও দাবি করেন অনেকে।

ডাকসুর সাবেক ভিপি আ স ম আবদুর রব, মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মাহমুদুর রহমান মান্না, আমানউল্লাহ আমান, আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, অধ্যাপক আসিফ নজরুল, অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান, অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস এবং গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকিসহ বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নেতারা সমাবেশে সংহতি জানান।

হামলার বিচার চায় সাদা দল

নুরুলদের ওপর হামলার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করে মানববন্ধন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপি-জামায়াত সমর্থক শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দল। গতকাল দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে ওই মানববন্ধন হয়। সমাবেশে সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চলছে। ভিন্নমতের ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে। শিক্ষক হিসেবে আমরা লজ্জিত।’

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া সন্তানদের নিরাপত্তা চেয়ে উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামানকে গতকাল বিকেলে স্মারকলিপি দিয়েছেন উদ্বিগ্ন অভিভাবক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।