সিদ্ধিরগঞ্জে চুন কারখানার ধোঁয়ায় মানুষজন অতিষ্ঠ

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের হিরাঝিল আবাসিক এলাকায় পাথর পুড়িয়ে চুন প্রস্তুত করা হচ্ছে। সম্প্রতি তোলা।  ছবি: প্রথম আলো
নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের হিরাঝিল আবাসিক এলাকায় পাথর পুড়িয়ে চুন প্রস্তুত করা হচ্ছে। সম্প্রতি তোলা। ছবি: প্রথম আলো

দিবানিশি জ্বলছে আগুন। কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীর সঙ্গে উড়ছে ছাই। এই ধোঁয়ার কুণ্ডলীর কারণে আশপাশের মানুষের জীবন অতিষ্ঠ। চুন কারখানার গ্যাসের কারণে নিশ্বাস নেওয়া কষ্টকর। দম বন্ধ হয়ে আসে। আশপাশের বাসিন্দাদের কমবেশি প্রায় সবার শ্বাসকষ্ট দেখা দিয়েছে।

আক্ষেপের সঙ্গে এ কথাগুলো বলেন নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের হিরাঝিল আবাসিক এলাকার একটি ছয়তলা ভবনের বাসিন্দা সাইফুল আলম। 

ওই ছয়তলা ভবনের পাশেই অবস্থিত দুটি চুন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স রনি লাইমস ও মেসার্স সুরমা লাইমস। তিন দশক ধরে গ্যাসের আগুনে কারখানাগুলোতে পাথর পুড়িয়ে চুন তৈরি করা হচ্ছে। চুন প্রস্তুতকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় আবাসিক এলাকায় নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা চুন তৈরি করে যাচ্ছেন। 

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডে শুধু ওই দুটি প্রতিষ্ঠানই নয়, ওই ওয়ার্ডে মোট নয়টি চুন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কারখানার আশপাশের বাসিন্দাদের সবাই চুন কারখানার আগুনের উত্তাপ, গন্ধ আর কালো ধোঁয়ার দূষণে নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, হিরাঝিল আবাসিক এলাকায় অবস্থিত রনি লাইমসে একটি ভাট্টিতে চুন পোড়ানো হচ্ছে। দাউ দাউ গ্যাসের আগুন জ্বলছে। কালো ধোঁয়ায় আশপাশ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে গেছে। রনি লাইমসের সীমানা ঘেঁষে রয়েছে মেসার্স সুরমা লাইমস। ওই দুই কারখানার আনুমানিক এক শ মিটারের মধ্যে মেসার্স মদিনা লাইমস নামে আরেকটি কারখানায় চুন তৈরি করা হচ্ছে।

এই তিন কারখানার মধ্যে সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ওমর ফারুকের কার্যালয়। রনি লাইমসের ভেতরে ৬৪ ফুট জায়গা ডিএনডি নিষ্কাশন খালের বলে চিহ্ন দিয়ে গেছে সেনাবাহিনী ও জেলা প্রশাসনের জরিপকারী দল। এ নিয়ে ডিএনডি ও রনি লাইমসের মধ্যে উচ্চ আদালতে মামলা চলছে।

রনি লাইমস, সুরমা লাইমস ও মদিনা লাইমসের চার পাশেই আবাসিক বহুতল ও টিনশেড ভবন। রনি ও সুরমা লাইমসের সীমানা ঘেঁষে দক্ষিণ পাশের চারতলা বাড়ির মালিক সফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘১৯৮৮ সালে আমাদের বাড়িটি টিনশেড ছিল। আমার বাবা বাড়িটি টিনশেড করার দু–তিন বছর আগে সেখানে সুরমা লাইমস ছিল। ১৯৯০ সালের দিকে গড়ে ওঠে রনি লাইমস। তখন থেকেই আমরা ভুগছি। এখানে যদি কেউ বসবাস না করে, তাঁকে বোঝানো যাবে না পরিস্থিতি কী? গ্যাসের আগুন যখন দাউ দাউ করে জ্বলে, তখন গন্ধ আর তাপে ঘরে থাকা কষ্ট হয়ে যায়। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়।’

ওই তিন কারখানার তিন-চার শ মিটার দূরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীমানা ঘেঁষে পশ্চিম পাশে মেসার্স ফয়সাল লাইমস। চুন প্রস্তুতের জন্য আনা পাথরগুলো ট্রাকে করে এনে প্রথমে মহাসড়কের ওপর রাখা হয়। পাথরগুলো ট্রাক থেকে নামানোর সময় মাঝেমধ্যে মহাসড়কে যান চলাচলেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। ফয়সাল লাইমসের অদূরে একটি চারতলা ভবনে মাদ্রাসা, একটি চারতলা আবাসিক ভবন, কয়েকটি টিনশেড বাড়ি আর কাছেই এক ভবনে কমিউনিটি সেন্টার ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে।

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার ডিএনডি সেচ খালের পাড়ে সিআইখোলা ও মক্কীনগর এলাকায় রয়েছে জাজিরা লাইমস, ঢাকা লাইমস, যমুনা লাইমস ও আরাফাত লাইমস। সিআইখোলা এলাকার বাসিন্দা শাহনেওয়াজ বলেন, চুন কারখানাগুলো গড়ে উঠেছিল ১৯৮৫ সাল থেকে ১৯৯২ সালের মধ্যে। তখন বসতি কম ছিল। 

এ বিষয়ে ঢাকা ও যমুনা লাইমসের মালিক খোরশেদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবাসিক এলাকায় আগে থেকে প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে। আমাদের সব চুন প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিতে পরিবেশ অধিদপ্তর ছয় মাসের সময় দিয়ে ছাড়পত্র দিয়েছে। সরকার যদি আমাদের নির্দিষ্ট কোনো জায়গা বরাদ্দ দেয়, তাহলে আমরা সব কারখানা সরিয়ে নেব।’ 

নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সাঈদ আনোয়ার বলেন, ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকায় কারখানাগুলোকে সরিয়ে নিতে ছয় মাসের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ওই সময়ের মধ্যে কারখানাগুলো সরিয়ে না নিলে সেগুলোর গ্যাস–সংযোগ বিচ্ছিন্নসহ লাইসেন্স নবায়ন করা হবে না।

জেলা প্রশাসক জসিম উদ্দিন বলেন, ‘আবাসিক এলাকায় যেসব চুন কারখানার রয়েছে, সেগুলোর বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নেব। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালতে সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’