ছোট্ট রাজস্থলী সন্ত্রাসের বড় জনপদ

>গত ১১ মাসে ১২ জন খুন। তিন পার্বত্য জেলার ২৬ উপজেলার মধ্যে এ উপজেলায় খুনের সংখ্যা সর্বোচ্চ। আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টাই কারণ।

রাঙামাটির ১০ উপজেলার মধ্যে আয়তনে সবচেয়ে ছোট রাজস্থলীতে গত ১১ মাসে ১২ জন খুন হয়েছেন। তিন পার্বত্য জেলার ২৬ উপজেলার মধ্যে এ উপজেলায় খুনের সংখ্যা সর্বোচ্চ। স্থানীয় বাসিন্দা, একাধিক রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের ভাষ্য, আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টাই এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কারণ।

তবে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যে সংঘাতজনিত যে খুনখারাবি, তা থেকে ভিন্ন রাজস্থলীর হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট। নানিয়ারচর, বাঘাইছড়ি কিংবা খাগড়াছড়ি সদরের হত্যাকাণ্ডগুলো ছিল চারটি আঞ্চলিক দলগুলোর বিরোধে। বর্তমানে সেখানে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও ইউপিডিএফ এক পক্ষে এবং অন্য পক্ষে জেএসএস (এম এন লারমা) ও ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিকের অবস্থান।

কিন্তু রাজস্থলীতে মূলত জেএসএস এবং মিয়ানমারের নিষিদ্ধ ঘোষিত সশস্ত্র সংগঠন আরাকান লিবারেশন পার্টির (এএলপি) একটি দলছুট অংশ ‘মগ পার্টি’র মধ্যে খুনোখুনির ঘটনা ঘটছে। এখানে দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্য ছিল জেএসএসের। গত জাতীয় নির্বাচনের আগে থেকে মগ পার্টির আবির্ভাব ঘটে। এরপর শুরু হয় আধিপত্যের সংঘাত। জেএসএস মনে করে, মগ পার্টির সঙ্গে তাদের বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলোর একটা সখ্য রয়েছে, যার কারণে শান্ত রাজস্থলীতে রক্ত ঝরছে।

রাজস্থলীর বাসিন্দা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের বড় নাগরিক সংগঠন বন ও ভূমি অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের সদস্যসচিব সুদত্ত বিকাশ তঞ্চঙ্গ্যা বলছিলেন, ‘এ উপজেলায় এমন পরিস্থিতি আগে ঘটেনি। আমরা সত্যিই শঙ্কিত।’

পুলিশ সূত্র জানায়, গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাজস্থলীর রাইখালীর কারিগর পাড়ায় জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) কর্মী মংসুইন মারমা (৪০) ও স্থানীয় মো. জাহেদ (২৫) সন্ত্রাসীদের গুলিতে নিহত হন। সর্বশেষ ১৮ নভেম্বর গুলিতে নিহত হন আরও তিনজন।

রাজস্থলী বান্দরবানসংলগ্ন অঞ্চল। কর্ণফুলী নদী উপজেলাকে রাঙামাটির মূল ভূখণ্ড থেকে পৃথক করেছে। এখানে সন্ত্রাসী তৎপরতা শুরু হয় গত ফেব্রুয়ারিতে। এসব ঘটনার জন্য মগ পার্টিকে দায়ী করেছে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস)। মগ পার্টির সঙ্গে স্থানীয় কিছু বিপথগামী মারমা যুবক ভিড়ে যায়। নির্বাচনের সময় তারা এক প্রার্থীর পক্ষে কাজ করে বলে অভিযোগ।

জেএসএসের প্রভাব বান্দরবানে বরাবরই কম। এই দলের কেন্দ্রীয় কোনো নেতাকেই এখন কথা বলার জন্য পাওয়া যায় না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দুজন নেতা বলেন, কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড় ‘জেএসএস মুক্ত’ করার জন্যই নির্বাচনের সময় থেকে ক্ষমতাসীনেরা মগ পার্টিকে মদদ দিচ্ছে। এর ফলেই সংঘাত।

বান্দরবান আসন নিশ্চিত করতেই শাসক দলের কেউ কেউ মগ পার্টিকে এনেছিল বলে যে অভিযোগ আছে, তা উড়িয়ে দেন বান্দরবানের সাংসদ ও পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং।

রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুসা মাতব্বর বলেন, ‘আমরা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সব সময় কথা বলি। মগ পার্টির মতো কোনো সশস্ত্র দলের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ নেই। কোনো দলকে এলাকা ছাড়া করার লক্ষ্যও নেই।’

রাজস্থলীর মতো ছোট একটি এলাকায় এতগুলো মানুষ খুন হওয়ার ঘটনাকে ‘ভয়াবহ’ বলে আখ্যায়িত করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যর্থতা আছে পুরোদমে।’