১৩ বছরে হয়নি, আর দু-এক বছরে হওয়ার 'আশা'

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আফতাব উদ্দিন আহমেদ।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আফতাব উদ্দিন আহমেদ।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আফতাব উদ্দিন আহমেদ হত্যাকাণ্ডের রহস্যের জট খোলেনি ১৩ বছরেও। তাঁকে কারা খুন করেছে, এত বছরেও পুলিশ তাদের শনাক্ত করতে পারেনি।

মামলার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি কর্মকর্তারা বলেছেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্যে উঠে আসা আফতাব হত্যায় জড়িতদের নাগাল পাচ্ছে না সিআইডি। তবে তারা মনে করছে, খুনিদের ব্যাপারে তথ্য পেতে এবং রহস্যের জট খুলতে আরও এক বা দুই বছর লাগতে পারে।

মামলার বর্তমান তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, আফতাব হত্যা মামলাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের মামলা। অনেক দিন ধরে সেলের সভা হয় না। ওই হত্যা মামলায় নাম আসা সন্ত্রাসী তানভীরুল ইসলাম দেশের বাইরে আছেন। সভা হলে সেখানে তদন্তের ফল উপস্থাপন করা হবে। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত আসার পর মামলাটির নিষ্পত্তি করা হবে।

ওই কর্মকর্তা এ–ও বলেন, এটি চাঞ্চল্যকর লোমহর্ষক মামলা। তথ্য বেরিয়ে আসতে আরও এক বছর কিংবা দুই বছরও লাগতে পারে। তবে তদন্তের অগ্রগতি আছে বলে দাবি তাঁর।

২০০৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর রাত পৌনে আটটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডের বাসায় দুর্বৃত্তরা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আফতাব উদ্দিনকে গুলি করে। সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে তিন দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ২৬ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান। এ ঘটনায় আফতাবের স্ত্রী নুরজাহান শাহবাগ থানায় হত্যা মামলা করেন। ২০১৫ সালে নুরজাহান মারা যান। আফতাব-নুরজাহান দম্পতি নিঃসন্তান ছিলেন। তাঁদের পালিত ও প্রতিবন্ধী মেয়েটিও পরে মারা যান। বাদীর মৃত্যুর পর আফতাবের স্বজন, সহকর্মী বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের কেউ এ মামলা নিয়ে সোচ্চার হননি।

মামলার তদন্তকারী সংস্থা অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) সূত্র জানায়, প্রথমে আফতাব হত্যা মামলাটি শাহবাগ থানার পুলিশ তদন্ত করে। পরে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগকে (ডিবি) দেওয়া হয়। এ নিয়ে তদন্ত কর্মকর্তা পাল্টেছেন ১২ জন। কিন্তু কাজের কাজ হয়নি কিছুতেই।

তদন্ত সম্পৃক্ত সিআইডির একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ভারত থেকে ফেরত আনা শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন ২০০৮ সালে আফতাব হত্যার ঘটনায় নিজেকে না জড়িয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এতে সানজিদুল ইসলাম বলেন, তিনি ভারতে অবস্থানকালে তানভীরুল ইসলাম জয়ের সহযোগী কাঁকন ও ল্যাংড়া তাজগীর তাঁকে বলেছিলেন, তানভীরুল ইসলাম ওরফে জয় ও তাঁর লোক আবলান, রফিক, এতিম বেলাল, খোকন ও মাহবুব এই হত্যায় জড়িত। আবলান, রফিক ও এতিম বেলাল বাসায় গিয়ে আফতাবকে গুলি করেন। তাঁদের মধ্যে খোকন ২০০৬ সালে রমনায় পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন এবং আবলান ২০০৮ সালের নভেম্বরে মোহাম্মদপুরে খুন হন। রফিক, এতিম বেলাল ও মাহাবুবের পুরো ঠিকানা পাওয়া যায়নি।

মামলার তদন্ত–সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ভারত থেকে ফিরিয়ে আনা তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমনের জবানবন্দি ও গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে উঠে আসে সাবেক সাংসদ ও বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা মফিদুল হাসান তৃপ্তির নাম। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পেরেছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠা ‘হাওয়া ভবনে’ আফতাব হত্যার টাকা লেনদেন হয়। আর এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন মফিদুল ইসলাম।

২০০৮ সালের আগেই শোয়েব সাইফ এবং সন্দেহভাজন হুমায়ুন কবীর ওরফে মুন্না ও সালেহ আহম্মদ ওরফে সুজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তাঁরা এ বিষয়ে কিছু বলেননি।
সর্বশেষ গত বছরের ৮ আগস্ট সিআইডি বিএনপির সাবেক সাংসদ মফিদুল হাসানকে গ্রেপ্তার করে তাঁর ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন জানিয়ে আদালতে হাজির করেন। তাঁর আইনজীবী মাসুদ আহম্মেদ তালুকদার তাঁর জামিনের আবেদন জানিয়ে বলেন, ‘হাইকোর্ট কোনো মামলায় তৃপ্তিকে হয়রানি না করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। এ মামলায় তাঁকে রিমান্ডে নিলে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অমান্য করা হবে।’ পরে শুনানি শেষে আদালত জামিন নামঞ্জুর করে তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন।

তদন্ত সম্পৃক্ত সিআইডির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, আফতাব হত্যায় গ্রেপ্তার সবাই কারাগার থেকে জামিনে বেরিয়ে গেছেন। সাবকে সাংসদ মফিদুলের কাছ থেকেও পুলিশ কোনো তথ্য পায়নি। তাঁর রিমান্ড মঞ্জুর হলে কিছু তথ্য পাওয়া যেত। রিমান্ড আবেদন নাকচ করে তৃপ্তিকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন বিচারক। এ কারণে তাঁর কাছ থেকে কিছু বের করা যায়নি।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সদ্য বিদায়ী সিআইডির বিশেষ সুপার মো. এনামুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের তথ্যে উঠে আসা আফতাব খুনে জড়িত সন্ত্রাসী তানভীরুল ইসলাম অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছেন বলে পুলিশ জানতে পারে। তাঁকে ধরতে পুলিশের আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলের সহযোগিতা চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানে তার খোঁজ পাওয়া যায়নি। আর গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের ওই হত্যায় সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।

সিআইডির ওই কর্মকর্তা বলেন, আফতাব হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া দুই আসামি বেঁচে থাকলে হত্যার পেছনে থাকা ব্যক্তিসহ হত্যায় জড়িত সবার নাম জানা যেত। ওই হত্যা মামলা নিয়ে কোনো আশার আলো দেখছেন না তিনি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের মামলাটি পরের সভায় অন্য কোনো সংস্থাকে দিয়ে তদন্তের সুপারিশ করবে সিআইডি।

প্রসঙ্গত, আফতাব আহমদ বিএনপিপন্থী শিক্ষক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। গণমাধ্যমের সমালোচনায় উপাচার্য হিসেবে দ্বিতীয় দফায় তাঁকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেননি সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে আফতাব আহমেদ খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কুৎসা রটানো ও বিষোদ্গার করেন। হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এ ঘটনার জন্য ওই সময়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থাকে দায়ী করে বক্তব্য দিয়েছিল। দলটির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে নিয়ে বই লিখতে তিনি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকাও নিয়েছিলেন বলে সে সময় প্রচার ছিল। তবে পরে কোনো কারণে সরকারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের অবনতি হয় এবং তিনি বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশনে সরকারের সমালোচনাও করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতেই তাঁর খুনের বিষয়টিতে সরকারের একাংশের বিরাগভাজন হওয়ার বিষয়টি নিয়ে তখন আলোচনা শুরু হয়।