টেলিভিশনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে ইন্টারনেট

অবসরে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে গল্পগুজব করেন, এমন তরুণের সংখ্যা আগের চেয়ে বেড়েছে। তবে পরিবারকে আগে যে সময় দিতেন, তা গড় হিসাবে কিছুটা কমেছে। অবশ্য অবসর কাটানোর ক্ষেত্রে এখনো তাঁদের সবচেয়ে বেশি পছন্দ টেলিভিশন। যদিও আগের চেয়ে সেই ঝোঁক কিছুটা কমে আসছে। সেখানে ইন্টারনেটে সময় কাটানোর প্রবণতা অনেক বেড়েছে। অবসরের মাধ্যম হিসেবে এখন টেলিভিশনের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠছে ইন্টারনেট।

দেশের তারুণ্যের ভাবনা জানতে প্রথম আলোর উদ্যোগে পেশাদার জরিপ সংস্থা ওআরজি-কোয়েস্ট পরিচালিত জরিপে তরুণ–তরুণীদের অবসর কাটানোর এমন চিত্র পাওয়া গেছে। এই জরিপে ১৫–৩০ বছর বয়সী ১ হাজার ২০০ জন অংশ নেন।

দুই বছর আগেও এই জরিপ করেছিল প্রথম আলো। ২০১৭ সালের সেই জরিপের সঙ্গে তুলনা করলে এবার তরুণ–তরুণীদের অবসর জগতে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। যেমন অবসরে তাঁরা এখন আগের চেয়ে কিছুটা কম ঘুমান। সংবাদপত্র ও পাঠ্যসূচির বাইরের বই পড়া আগের চেয়ে কমেছে।

টেলিভিশন প্রথম পছন্দ হলেও ঝোঁক কমছে

লেখাপড়া, চাকরিসহ নিত্যদিনের কাজের ফাঁকে কিংবা ছুটিতে তরুণ–তরুণীরা নানাভাবে অবসর কাটান। কখনো সময় কাটান সৃষ্টিশীল কাজে, কখনো বিনোদনে। যেমন ২০১৭ সালের জরিপ অনুযায়ী, ৮০ দশমিক ৬ শতাংশ অবসরে টেলিভিশন দেখার কথা বলেছিলেন। দুই বছরের ব্যবধানে টেলিভিশন দেখার হার কিছুটা কমেছে। এবার ৭৮ দশমিক ২ শতাংশ টেলিভিশনের কথা উল্লেখ করেছেন। তবে অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগে কোন দেশের টেলিভিশন অনুষ্ঠান বেশি দেখেন, এ ধরনের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রশ্ন জরিপে করা হয়নি।

টেলিভিশন দেখার সময়ও কমেছে তাঁদের। আগে দিনে গড়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা টিভি দেখার কথা বলেছিলেন তাঁরা। এখন তা কমে ঘণ্টাখানেকে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের দেখা পছন্দের অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে নাটক, খবর, সিনেমা ও গান। এর মধ্যে তরুণ–তরুণীদের অর্ধেকের বেশির কাছে জনপ্রিয় হলো নাটক ও খবর। যদিও এ দুটির জনপ্রিয়তা, বিশেষ করে খবরের জনপ্রিয়তা অনেকটা কমেছে। সেই তুলনায় সিনেমা দেখা, গান শোনা কিছুটা বেড়েছে।

>

সবচেয়ে বেশি পছন্দ টেলিভিশন হলেও তা আগের চেয়ে কমে আসছে। ইন্টারনেটে সময় কাটানোর প্রবণতা বেড়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাট্য সংগঠক ও অভিনেতা রামেন্দু মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ‘টেলিভিশনের অনুষ্ঠানের মান তেমন বাড়েনি। এ কারণে টেলিভিশনের প্রতি তাঁদের আগ্রহ হয়তো কমে আসছে। তবে আগের চেয়ে খবরের জনপ্রিয়তা কমার কারণটি পরিষ্কার নয়। হয়তো তাদের রাজনীতিবিমুখতার কারণে তারা খবর কম দেখতে পারে।’

গল্পগুজব ও ইন্টারনেটে যত সময়

তবে তরুণ–তরুণীরা অবসরের পুরোটাই টেলিভিশনে কাটান না। পরিবার–পরিজন ও বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করে ও আড্ডা দিয়ে এবং ইন্টারনেটেও কাটান বড় একটা সময়। জরিপ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৭ সালে তাঁদের ৪৩ শতাংশ বলেছিলেন, অবসরের দ্বিতীয় পছন্দ পরিবারের সঙ্গে গল্প করে সময় কাটানো। সেখানে এবার ৬০ শতাংশের বেশি পরিবারের সঙ্গে গল্পগুজব করার কথা জানিয়েছেন। অর্থাৎ এখন তাঁদের মধ্যে পরিবারের সঙ্গে অবসর কাটানোর প্রবণতা আগের চেয়ে বেড়েছে। টেলিভিশন দেখা ও গল্পগুজব—এই দুই পছন্দের মধ্যে ব্যবধানও কমে এসেছে। আগে এই দুই পছন্দের মধ্যে ব্যবধান ছিল ৩৭ দশমিক ৬ শতাংশ। এবার তা কমে হয়েছে ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ।

আবার পরিবারের সঙ্গে গল্প বা আড্ডা দিয়ে সময় কাটানো মেয়েদের সংখ্যা পুরুষের চেয়ে বেশি। আর ২৫ থেকে ৩০ বছর বয়সীদের মধ্যে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। পরিবারের সঙ্গে গল্প বা আড্ডা দেওয়ার সংখ্যা বাড়লেও তাদের সময় দেওয়ার গড় আগের চেয়ে কিছুটা কমেছে। আগে যেখানে তাঁরা দিনে গড়ে এক ঘণ্টার বেশি সময় দিতেন, সেখানে এখন তার চেয়ে প্রায় ১৫ মিনিট সময় কম দেন।

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, এখন তরুণ–তরুণীরা অবসরে সবচেয়ে বেশি সময় দিচ্ছেন ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। তাঁরা গড়ে প্রতিদিন ৮৭ মিনিট বা প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় ইন্টারনেটে কাটান। ২০১৭ সালে তা ছিল ৮০ মিনিট। এ প্রবণতা শহুরে ও উচ্চশিক্ষিত তরুণ–তরুণীদের মধ্যে তুলনামূলক বেশি। এই দুই শ্রেণি প্রতিদিন গড়ে ১০০ মিনিটের বেশি সময় কাটায় ইন্টারনেটে।

শহুরে তরুণ–তরুণীদের মধ্যে ইন্টারনেটের জনপ্রিয়তা সবচেয়ে বেশি হওয়ার কারণও জরিপে উঠে এসেছে। ইন্টারনেট এখন তাঁদের তাত্ক্ষণিকভাবে সংবাদ জানার উৎস। বিদেশে থাকা পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমও এটি। ইন্টারনেট সংবাদ দেখা, গান শোনা এবং টেলিভিশন দেখারও সুযোগ করে দিয়েছে। আবার কোনো তথ্য তাৎক্ষণিক ও দ্রুত জানতে ইন্টারনেটের ব্যবহার হচ্ছে।

ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাঁদের তৃতীয় পছন্দ হলেও অন্য মাধ্যমগুলোর তুলনায় এটির প্রতি ঝোঁক বেশ বেড়েছে। শীর্ষে থাকা টেলিভিশনের এখন বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সামনে এসেছে ইন্টারনেট। ২০১৭ সালে তাঁদের ৪১ দশমিক ৬ শতাংশ বলেছিলেন, ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাঁদের অবসরের পছন্দ। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৫৩ দশমিক ৪ শতাংশ।

তবে বেশির ভাগ তরুণ–তরুণী একমত যে বর্তমানে তরুণ প্রজন্ম ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব বেশি সময় ব্যয় করে। যার নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। এ জন্য তারা দেশে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রভাব, হতাশা, সাইবার অপরাধ বৃদ্ধি, জালিয়াতি, ধর্ষণ, মাদকাসক্তি এবং ভুয়া সংবাদ ছড়িয়ে দেওয়ার প্রবণতাকে দুষছে। আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাঁদের পেশা গড়ার পথে বাধা হিসেবেও কাজ করছে। বয়স্কদের চেয়ে কম বয়সী তরুণ–তরুণীদের ওপর ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নেতিবাচক প্রভাব বেশি। যাঁরা ইন্টারনেট ব্যবহারের ভালো–মন্দ দিকগুলো বুঝতে পেরেছেন, তাঁরাই এই মাধ্যমের সুবিধা পাচ্ছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তথ্যপ্রযুক্তিবিদ সুমন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ইন্টারনেট ব্যবহারের পরিধি দ্রুতই বাড়ছে। এর ফলে অচিরেই বিনোদন কিংবা সংবাদের উৎস হিসেবে ইন্টারনেট প্রথম স্থান নিয়ে নেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে একই সঙ্গে ইন্টারনেট বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসক্তির বিষয়েও সতর্ক থাকা দরকার বলে মনে করেন তিনি। তাঁরা দিনে গড়ে দুই ঘণ্টার বেশি ইন্টারনেট ব্যবহার করলে তা দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে ওঠে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ইন্টারনেটের পুরো জগৎটা তাঁদের বোঝা দরকার, বোঝানো দরকার। এ ক্ষেত্রে শিক্ষক কিংবা অভিভাবকদের কী করা উচিত, তা সমাজবিজ্ঞানীরাই ভালো বলতে পারবেন।

সংবাদপত্র, ঘুম ও খেলা

অবসরে ঘুমানো তরুণ–তরুণীদের পঞ্চম পছন্দ। জরিপে তাঁদের ৩৯ শতাংশ বলেছেন, অবসরে ঘুমান। অবশ্য অবসর কাটানোর সময় হিসেবে ঘুমানোর অভ্যাস পছন্দের তালিকায় দ্বিতীয়। অবসরে তাঁরা দিনে গড়ে সোয়া ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটানোর কথা বলেছেন। গতবারের জরিপ অনুযায়ী, তাঁরা দিনে গড়ে ঘুমাতেন ৬৯ মিনিট। অবসরে ছেলেদের (২৭ দশমিক ৪ শতাংশ) চেয়ে মেয়েরা (৫০ দশমিক ৫ শতাংশ) ঘুমানোর কথা বলেছেন বেশি।

 ২০১৭ সালে তাঁদের ২৪ দশমিক ৪ শতাংশ বলেছিলেন, অবসরে তাঁরা খেলাধুলা করেন। ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয়েছে ২৮ দশমিক ২ শতাংশ। তবে খেলাধুলায় সময় ব্যয় আগের তুলনায় কমেছে। আগে অবসরে দিনে গড়ে ৮০ মিনিট সময় ব্যয় করতেন তাঁরা, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬২ মিনিট।

জরিপ বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, সংবাদপত্র ও বই (পাঠ্যপুস্তকের বাইরের) পড়ে অবসর কাটানোর প্রবণতা আগের চেয়ে কমেছে। ২০১৭ সালে তাঁদের প্রতি ১০ জনের তিনজন বলেছিলেন, অবসরে তাঁরা সংবাদপত্র ও বই পড়েন। এবার জরিপে মোটের ওপর তাঁদের প্রায় দুজনের উত্তরে এই অভ্যাসের কথা এসেছে। আগে তাঁরা দিনে গড়ে ৩৪ মিনিট সময় দিতেন সংবাদপত্রে, এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৯ মিনিটে।

তবে তথ্য জানার উৎস হিসেবে ছাপা সংবাদপত্র ও অনলাইন নিউজ পোর্টালের গুরুত্ব আগের তুলনায় বেড়েছে। সবচেয়ে বেড়েছে অনলাইন নিউজ পোর্টাল। আগে তাঁদের মাত্র ৯ শতাংশ বলেছিলেন, তথ্য জানার উৎস অনলাইন নিউজ পোর্টাল; এবার তা বেড়ে হয়েছে ২৮ দশমিক ৬ শতাংশ।

তরুণ–তরুণীদের অবসরভাবনা নিয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন প্রথম আলোকে বলেন, সময় কাটানোর জন্য সামাজিক মাধ্যম ও ইন্টারনেটে তাঁরা আগের চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করেন, এটি বৈশ্বিক চিত্র থেকে খুব ভিন্ন নয়। গণযোগাযোগ ও আন্তর্ব্যক্তিক যোগাযোগ সব সময় পরস্পরবিচ্ছিন্নও নয়। সবার সঙ্গে টেলিভিশন দেখা যেমন পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোর পরিপূরক হতে পারে; তেমনি সামাজিক মাধ্যমে পরিবার ও বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সময় কাটানোর ছবি দেওয়া বা গল্প শেয়ার করাও কিন্তু আকর্ষণ হতে পারে।

তরুণ–তরুণীদের তথ্য জানার আগ্রহেরও কমতি হয়নি উল্লেখ করে গীতি আরা নাসরিন বলেন, সব মাধ্যমের কাছেই তাঁদের বড় একটি প্রত্যাশিত বিষয় খবর। তথ্য-স্মার্ট থাকতে চান। দ্রুত সেই তথ্য পেতেও চান। সুতরাং বিভিন্ন মাধ্যমে সঠিক তথ্য পাওয়া বা নেতিবাচক তথ্য পাওয়ার মতো যে সমস্যাগুলো তাঁরা শনাক্ত করছেন, সেগুলো অতিক্রম করতে তাঁদের সহায়তা করা, অর্থাৎ তাঁদের মিডিয়া-সাক্ষর করে তোলা এখন একটি জরুরি বিষয়।

অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিনের মতে, ডিজিটাল জগতে অতিরিক্ত সময় কাটানো কমিয়ে আনার জন্য আরও দরকার অবসর কাটানোর বিকল্প সুযোগ তৈরি। তাঁরা খেলাধুলা কম করছেন, কিংবা বই কম পড়ছেন, এ বিষয়ে শুধু ইন্টারনেটকে দুষে তো লাভ নেই। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুললে, ইন্টারনেটেও তাঁরা ই-বই পড়বেন। কিংবা খেলাধুলার সুযোগ ও পরিসর থাকলে হয়তো এত দূর স্ক্রিননির্ভর তাঁরা হবেন না। সুতরাং তরুণ–তরুণীদের যথাযথ মানসিক ও শারীরিক বিকাশের জন্য সামগ্রিকভাবে তাঁদের সুস্থ ও গঠনমূলক অবসর কাটানোর সুযোগ তৈরি করা নিয়েও চিন্তা করতে হবে।