তিতাস গ্যাসক্ষেত্র: কম্প্রেসর কেনার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাস প্রসেস প্ল্যান্ট।  ফাইল ছবি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস গ্যাসক্ষেত্রের গ্যাস প্রসেস প্ল্যান্ট। ফাইল ছবি

বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) ৯০০ কোটি টাকার বেশি মূল্যের সাতটি কম্প্রেসর স্থাপনের কাজ পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের টেকনো স্ট্রিম এনার্জি। অথচ প্রতিষ্ঠান দুটি জামানতের ৮৫ কোটি টাকা দিতে পারেনি। এই টাকা তাদের হয়ে দিয়েছে লোকাল এজেন্ট (স্থানীয় কমিশন এজেন্ট)। প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাষ্ট্রের যে ঠিকানা ব্যবহার করেছে, সেটি ঠিক নয়। ফলে এই কোম্পানির অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে।

বিজিএফসিএলের অধীনে থাকা দেশের অন্যতম বড় গ্যাসক্ষেত্র হলো তিতাস। তিতাস ক্ষেত্রের গ্যাস উৎপাদন কমে যাওয়ায় সেখানে সাতটি অয়েল হেড কম্প্রেসর কেনার সিদ্ধান্ত হয়। দৈনিক ৬ কোটি ঘনফুট গ্যাস উত্তোলনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে ৯১০ কোটি টাকা ব্যয়ে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণে এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ২০১৮ সালের ২৫ নভেম্বর দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ছিল ৩ মার্চ। দরপত্রে সাতটি প্রতিষ্ঠান অংশ নেয়। এর মধ্যে দুটি কোম্পানির প্রস্তাবকে বিজিএফসিএল কর্তৃপক্ষ যোগ্য ঘোষণা করে। তার মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে মনোনীত হয় যুক্তরাষ্ট্রের হিউস্টনে অবস্থিত টেকনো স্ট্রিম এনার্জি নামের প্রতিষ্ঠানটি। আর বিজিএফসিএল কর্তৃপক্ষ ১৭ সেপ্টেম্বর চিঠি দিয়ে চুক্তি সম্পাদনের নোটিশ দেয়।

নিয়ম অনুযায়ী, নোটিশ পাঠানোর ২৮ দিনের মধ্যে দরপত্র জামানত সাড়ে ১২ কোটি (বিড বন্ড) টাকা ও কার্য সম্পাদন জামানত ৭২ কোটি টাকা জমা দেওয়ার কথা। এসব কাজ শেষ করে চূড়ান্ত চুক্তি করার শেষ সময় ছিল ১০ অক্টোবর। এর মধ্যে টেকনো স্ট্রিমের স্থানীয় প্রতিনিধি মজুমদার এন্টারপ্রাইজ প্রতিষ্ঠানটির পক্ষে বিড বন্ডের সাড়ে ১২ কোটি টাকা জমা দিলেও প্রায় ৭২ কোটি টাকার কার্য সম্পাদন জামানত জমা পড়েনি।

বিজিএফসিএলের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, জামানত ৭২ কোটি টাকা সময়মতো তো জমাই দেয়নি; উপরন্তু বিজিএফসিএলের দরপত্র জামানতের সাড়ে ১২ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে স্থানীয় এজেন্ট।

বিজিএফসিএলের দুই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, টেকনো স্ট্রিম এনার্জি একটি নামসর্বস্ব কোম্পানি। এটিকে সামনে রেখে মজুমদার এন্টারপ্রাইজ কাজটি নিয়েছিল। তারা এ কাজ বিভিন্ন কোম্পানির কাছে বিক্রি করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। স্থানীয় এজেন্ট মজুমদার এন্টারপ্রাইজ এবার সঙ্গে নিয়েছে দেশীয় পাইপ লাইনার্স লিমিটেডকে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের জ্বালানি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্ধারিত সময় জামানতের অর্থ দিতে ব্যর্থ হওয়ায় এখন টেকনো স্ট্রিমকে কাজটি দিতে হলে প্রথমে চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে হবে। অথচ এর আগেই প্রকল্প পরিচালক আবুল জাহিদ ই–মেইলের মাধ্যমে কার্য সম্পাদন জামানতের অর্থ জমা দিতে অনুরোধ জানিয়েছেন।

>

৯১০ কোটি টাকার কম্প্রেসর স্থাপনের কাজ পেয়েছে বিদেশি কোম্পানি। এই প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন।

বিজিএফসিএলের ওই কর্মকর্তারা আরও বলেন, ৪ ডিসেম্বর টেকনো স্ট্রিমের পক্ষে রিকার্ডো সিঅনতি (Riccardo Scionti) কম্প্রেসর কেনার প্রকল্প পরিচালক মো. আবুল জাহিদকে ই–মেইলে জানান, তাঁরা কার্য সম্পাদন জামানতের অর্থ দিতে প্রস্তুত। এই চিঠির পর ৯ ডিসেম্বর এনসিসি ব্যাংকে টেকনো স্ট্রিমের পক্ষে বাংলাদেশের আরেক ঠিকাদার পাইপ লাইনার্স লিমিটেড প্রায় ৭২ কোটি টাকা জমা দেয়।

জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এখন টেকনো স্ট্রিম এনার্জির সঙ্গে চূড়ান্ত চুক্তি করতে হলে প্রথমেই বিজিএফসিএলের বোর্ড সভায় চুক্তির মেয়াদ ১০ অক্টোবর থেকে বাড়িয়ে ভূতাপেক্ষ অনুমোদন দিতে হবে।

টেকনো স্ট্রিমের আর্থিক সক্ষমতা না থাকা প্রসঙ্গে জ্বালানিসচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনীম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না।’

এ বিষয়ে বিজিএফসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. তাওফিকুর রহমান ও প্রকল্প পরিচালক আবুল জাহিদের ব্যক্তিগত মুঠোফোনে গত ২৯ নভেম্বর থেকে ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত ফোন করে এবং খুদে বার্তা পাঠিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি।

টেকনো স্ট্রিম এনার্জি নিয়ে অনেক প্রশ্ন

জ্বালানি বিভাগের কর্মকর্তা ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা অভিযোগ করেছেন, যে প্রতিষ্ঠানটিকে ৯১০ কোটি টাকা মূল্যের কাজ দেওয়া হয়েছে, তারা প্রকল্পের জন্য জামানত জোগাড় করতে পারেনি। আর্থিকভাবে এ রকম দুর্বল একটি প্রতিষ্ঠানকে এত বড় কাজ দেওয়া হলে তারা নিজেরা এটি না করে বিক্রি করে দেবে।

দরপত্রে অংশ নেওয়া ফেয়ার ডিল ফাউন্ডেশনের ইকবাল হোসেন গত ২৫ অক্টোবর জ্বালানিসচিবকে লেখা চিঠিতে দাবি করেন, টেকনো স্ট্রিম নামে যুক্তরাষ্ট্রে বাস্তবে কোনো কোম্পানি নেই। বিজিএফসিএলের দুজন কর্মকর্তা বলেছেন, টেকনো স্ট্রিম যুক্তরাষ্ট্রের যে ঠিকানা তাদের ওয়েবসাইটে দিয়েছে, সেটি হলো ১৮০০ বেরিং ডিআর, স্যুট নম্বর ৮৫০। অথচ তারা যে ই–মেইল করেছে, সেখানে তারা ঠিকানা দিয়েছে একই ভবনের স্যুট নম্বর ৯৩৫।

ওই দুই কর্মকর্তা আরও বলেন, ৯৩৫ নম্বর স্যুটটি বর্তমানে খালি আছে। এটি ভাড়ার জন্য সম্প্রতি বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। আর ওয়েবপেজে দেওয়া ৮৫০ নম্বর স্যুটে বর্তমানে ভাড়া আছে ইপসল নামের জ্বালানি খাতের আরেকটি কোম্পানি।

বাড়িভাড়ার বিজ্ঞাপন দেখে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ই–মেইলে যোগাযোগ করা হলে স্ট্রিম রিয়েলিটি পার্টনারসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রেয়ান বারবালেস ১৯ ডিসেম্বর জানান, ৯৩৫ নম্বর স্যুটটি ফাঁকা আছে। সেখানে কোনো ভাড়াটে নেই।

বাংলাদেশের অন্যতম বড় গ্যাসক্ষেত্র হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস। এর চাপ ও উত্তোলনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে (জ্বালানির ভাষায় ডিপ্লেটিং ফিল্ড)। এখানে গ্যাসের চাপ বাড়াতে সাতটি কম্প্রেসর কেনা সম্পন্ন হলে গ্যাস উত্তোলন বাড়বে। কম্প্রেসর কিনতে দেরি হলে গ্যাসের চাপ আরও কমে সংকট বাড়বে।

এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, আর্থিক সক্ষমতা ছাড়াই একটি নামসর্বস্ব কোম্পানি যখন কাজ পায়, তখন বুঝতে হবে যে এর মধ্যে দুর্নীতি আছে। তিনি মনে করেন, প্রথমে কথিত ওই মার্কিন কোম্পানির কার্যাদেশ বাতিল করতে হবে। সেটা না হলে বুঝতে হবে, কারও স্বার্থ রক্ষা করার জন্য এটি করা হচ্ছে।