নানামুখী পদক্ষেপে শৃঙ্খলা ফিরছে দৌলতদিয়া ঘাটে

রাজবাড়ীর বর্তমান পুলিশ সুপার গত কয়েক মাসে দৌলতদিয়া ঘাটে ফেরি পারাপারে ভিআইপি বাসপ্রথা বাতিলসহ নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। ফলে শৃঙ্খলা ফিরতে শুরু করেছে দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াতের গুরুত্বপূর্ণ এ ঘাটে।

জেলা পুলিশ ও ঘাটসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ও মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া নৌপথে প্রতিদিন তিন হাজার গাড়ি পার হয়। এগুলোর মধ্যে এক হাজার ট্রাক ও এক হাজার বাস থাকে। এসব ছাড়াও ১৫০ থেকে ২০০ এসি বাস থাকে। গত ঈদুল আজহার এক সপ্তাহ আগ থেকে ঘাটের ‘ভিআইপি বাস’ প্রথা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এখন সব বাসকে লাইনে দাঁড়িয়ে ফেরিতে উঠতে হচ্ছে। 

বাসচালকেরা বলেন, আগে এসি বাস থেকে মাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের মাসোহারা তোলা হতো। এর বদলে তাদের আগে পার করা হতো। সংঘবদ্ধ দালাল চক্রের সদস্যরা বুকিং কাউন্টারের চারপাশে থাকত। এ ছাড়া সব গাড়ির চালক বা সহকারীকে তাদের মাধ্যমে টিকিট কাটতে হতো। এ জন্য আদায় করা হতো নির্ধারিত টিকিট মূল্যের চেয়ে বাড়তি টাকা। কাঁচামাল বা পচনশীল দ্রব্যের গাড়ি আগে পার করার জন্য প্রতি গাড়ি থেকে দালালদের অতিরিক্ত এক থেকে দুই হাজার টাকা দিতে হতো। এ ছাড়া যেকোনো গাড়ির জন্য বুকিং কাউন্টারে টিকিট কাটতে গেলে দালালদের বাড়তি ৪০০ টাকা দিতে হতো।

দৌলতদিয়া ঘাটে দূরপাল্লার একটি বাসের তত্ত্বাবধায়ক ফজলুল হক বলেন, আগে ট্রাফিক পুলিশ ঘাটে ডিউটি করতে এলে টার্গেট নিয়ে নামতেন। খালি হাতে এসে রাত শেষে পকেট ভর্তি করে টাকা নিয়ে যেতেন। দালালদের দাপটে গাড়িচালক, সহকারীরা টিকিট কাটতে পারতেন না। এখন সেই সুযোগ নেই। নেই কাউন্টারের সামনে দালালদের উৎপাত।

ঘাটসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, আগে ফেরিস্বল্পতা, ভাঙনে ঘাট বিলীন, তীব্র স্রোতে ফেরি চলাচল ব্যাহত হলে দৌলতদিয়ায় যানজট লেগেই থাকত। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে আসা বিভিন্ন ধরনের যানবাহন। তখন কর্তব্যরত পুলিশের সহযোগিতায় দালাল চক্রের মাধ্যমে পণ্যবাহী গাড়ি আগে পার করা হতো। এখন আর সেই সুযোগ নেই। কারণ, এখন পণ্যবাহী ট্রাক আর ঘাটে থাকে না।

ঘাট পার হতে আসা ট্রাকগুলোকে ঘাট থেকে অন্তত ১৫ কিলোমিটার দূরে রাজবাড়ী-কুষ্টিয়া আঞ্চলিক মহাসড়কের ওপর সদর উপজেলার গোয়ালন্দ মোড় এলাকায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। ট্রাক পারাপার শুরু হলে ট্রাকগুলো ঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। এ ছাড়া ২৪ ঘণ্টার ৮ ঘণ্টা ট্রাক পারাপার বন্ধ রাখা হয়। বেলা ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ও রাত ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত ট্রাক পারাপার বন্ধ থাকে। ঘাটে অপেক্ষমাণ গাড়ি না থাকলে ট্রাক চলাচল করতে পারে। তবে পচনশীল দ্রব্য পারাপারকারী ট্রাক সিরিয়ালে অপেক্ষমাণ রাখা হয় না।

রাজবাড়ী জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সভাপতি আক্তারুজ্জামান হাসান বলেন, গোয়ালন্দ মোড় এলাকায় ট্রাক পার্কিংয়ের বিষয়টির সুফল তাঁরা পেতে শুরু করেছেন। কারণ, আগে যানজট বাঁধিয়ে ঘাটে ব্যাপক চাঁদাবাজি হতো। সিরিয়াল দেওয়ার নামে যাচ্ছেতাই অবস্থা বিদ্যমান ছিল। ট্রাকের চালকদের নানা দুর্ভোগে পড়তে হতো। এখন সে পরিস্থিতির অবসান হয়েছে। 

সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, গোয়ালন্দ মোড়ের পশ্চিম দিক থেকে রাস্তার বাম লেনে ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। গাড়ির সারি গোয়ালন্দ মোড় থেকে শুরু হয়ে আলীপুর ইউনিয়নের আলাদীপুর বাজার পর্যন্ত। এ সময় কথা হয় ট্রাকচালক ও সহকারীদের সঙ্গে।

>
  • পুলিশ সুপারের উদ্যোগ
  • আগে ঘাটে দালালদের দাপটে গাড়িচালক, সহকারীরা টিকিট কাটতে পারতেন না
  • এখন সেই সুযোগ নেই।

ট্রাকচালক সোলাইমান মিয়া বলেন, ‘এখন সরকারি রেটে টিকিট কাটা যায়। আগে দৌলতদিয়া ঘাট পার হতে দালাল ধরতে হতো। এখন দালাল লাগে না, ঘাটে গিয়েও আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না।’

জেলা পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, সাধারণ যাত্রীদের কথা চিন্তা করে প্রথমে ভিআইপি বাসপ্রথা বাতিল করা হয়েছে। ঘাটে যাত্রীদের সব দুর্ভোগের কেন্দ্রবিন্দু হলো যানজট। এই যানজট বেশির ভাগ সময়ে কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা হতো কায়েমি স্বার্থবাদীদের লাভের জন্য। আগে যানজটের আড়ালে দালাল, চাঁদাবাজ, অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টিসহ অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িতরা সক্রিয় ছিল। ঘাটে যানজট না থাকলে সব অসামাজিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকে।

পুলিশ সুপার আরও বলেন, সবার সহযোগিতায় ঘাটের গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি পয়েন্টে সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো হয়েছে এবং বুকিং কাউন্টারে সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) নিয়োজিত আছে। ফলে মাঝেমধ্যে যারা সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে, তাদের বিরুদ্ধেও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যরা জড়িত থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। গত পাঁচ মাসে অন্তত ৭০ জনকে এসব অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দুজন পুলিশ সার্জেন্ট ও দুজন কনস্টেবলকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।

বিআইডব্লিউটিসির দৌলতদিয়া কার্যালয়ের ব্যবস্থাপক আবু আবদুল্লাহ বলেন, আগে অনেকটা অনিয়মের মধ্য দিয়ে গাড়ি পার হতো। অনেক সময় পুলিশ কর্মকর্তাদের কথা বলে ভিআইপি হিসেবে গাড়ি ডান পাশের সড়ক দিয়ে ঘাটে যেত। তাঁরা দেখেও না দেখার ভান করতেন। কিন্তু এখন আর সেই সমস্যা নেই। বদলে গেছে ঘাটের সেই চিরচেনা অনিয়ম।