'আমার মেয়েরা কোথায়?'

কণিকা আক্তারের একটু জ্ঞান ফিরলেই জিজ্ঞেস করছেন স্বামী ও ছেলে-মেয়েদের কথা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ২৮ ডিসেম্বর। ছবি: সৌরভ দাশ
কণিকা আক্তারের একটু জ্ঞান ফিরলেই জিজ্ঞেস করছেন স্বামী ও ছেলে-মেয়েদের কথা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ২৮ ডিসেম্বর। ছবি: সৌরভ দাশ

সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো মাথা। ভেঙে গেছে কোমরের হাড়ও। জ্ঞান ফিরতেই ব্যথাই কাতরে উঠলেন। কিন্তু মুহূর্তেই নিজের সমস্ত ব্যথা লুকিয়ে কণিকা আক্তার বলে উঠলেন—‘আমার মেয়েরা কোথায়?’ স্বজনেরা তাঁকে জানাননি দুই মেয়ে আর স্বামীর অন্তিম পরিণতির কথা। বললেন, ‘তাঁরা সবাই সুস্থ আছেন, অন্য ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন।’

আজ শনিবার বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগে গিয়ে এই চিত্র দেখা যায়। এক দুর্ঘটনায় কণিকা আক্তার হারিয়েছেন স্বামী বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক সাইফুজ্জামান মন্টু (৪৫) আর দুই মেয়ে আশরা আমান খান (১৪) ও তাসনিম জামানকে (১২)।

আজ সকাল সাড়ে ৭টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফৌজদারহাট-বন্দর বাইপাস সংযোগ সড়ক এলাকায় লরির সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কায় নিহত হন তাঁরা। একই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে ছেলে মন্টিও (১০)। তাঁরা সবাই প্রাইভেটকারে করে ঢাকায় ফিরছিলেন। প্রাইভেটকারটি চালাচ্ছিলেন সাইফুজ্জামান নিজেই।

সাইফুজ্জামানের মৃত্যুর খবরে হাসপাতালে ছুটে আসেন তাঁর তিন ভাই কর্নেল নজরুল ইসলাম, জেলা সমাজসেবা কার্যালয়, কুমিল্লার উপপরিচালক জেড এম মিজানুর রহমান খান ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান। ১১ ভাইবোনের মধ্যে সাইফুজ্জামান ছিলেন ১০ম।

একই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে ছেলে মন্টিও। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ২৮ ডিসেম্বর। ছবি: সৌরভ দাশ
একই দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে ছেলে মন্টিও। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ২৮ ডিসেম্বর। ছবি: সৌরভ দাশ

জেড এম মিজানুর রহমান খান যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না এভাবে মুহূর্তেই নাই হয়ে যাবেন ছোট ভাই ও তাঁর দুই মেয়ে। বলেন, সাইফুজ্জামানের বড় মেয়ে আশরা ফেনী গার্লস ক্যাডেট কলেজের সপ্তম শ্রেণিতে পড়ত। ২৩ ডিসেম্বর তার পরীক্ষা শেষ হয়। সেদিনই ঢাকা থেকে ছোট মেয়ে ও ছেলে এবং স্ত্রীকে নিয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে প্রাইভেটকার নিয়ে রওনা হন সাইফুজ্জামান। ফেনী পৌঁছার পর তুলে নেন বড় মেয়েকে। পরে চট্টগ্রাম শহরে প্রাইভেটকারটি রেখে অন্য গাড়িতে করে তাঁরা বান্দরবানে যান। আজ সকালে চট্টগ্রাম শহরে ফিরে সেই প্রাইভেটকারটি চালিয়ে ঢাকায় ফেরার পথে দুর্ঘটনায় পড়েন।

চমেক হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগে চিকিৎসকের কক্ষে নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে শুধু কপালে হাত দিয়ে নির্বাক বসেছিলেন সাইফুজ্জামানের ছোট ভাই মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান।। কিন্তু ভাই এবং দুই ভাতিজির লাশ গ্রহণের নথিটি পুলিশ সদস্য বাড়িয়ে দিতেই নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান খান। সেই নথিতে সই করতে করতে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু।

স্মৃতির পাতা। পরিবারের সবাই মিলে কক্সবাজারে বেড়াতে যাওয়ার ছবি। ছবি: সংগৃহীত
স্মৃতির পাতা। পরিবারের সবাই মিলে কক্সবাজারে বেড়াতে যাওয়ার ছবি। ছবি: সংগৃহীত

বার আউলিয়া হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুল আউয়াল নিজেও চমেক হাসপাতালে আসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, দুর্ঘটনায় ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় দুই বোনের। গুরুতর আহত অবস্থায় সাইফুজ্জামান ও তাঁর স্ত্রী কণিকা আক্তার এবং ছেলে মন্টিকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন তাঁরা। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বেলা পৌনে ১১টার দিকে মারা যান সাইফুজ্জামান।

নিউরোসার্জারি বিভাগ থেকে আজ বিকেলে মা ও ছেলেকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল, চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। তাদের মধ্যে ছেলের অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন স্বজনেরা।

এর আগে ময়নাতদন্ত ছাড়াই সাইফুজ্জামান ও তাঁর দুই মেয়ের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। নিথর ভাই ও দুই ভাতিজির নিথর দেহ নিয়ে চাঁদপুর জেলার হাজিগঞ্জের নিশ্চিন্তপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হন তিন ভাই। সেখানেই জানাজা শেষে বাবা ও দুই মেয়েকে চিরদিনের জন্য কবরে শুইয়ে দেওয়া হবে।