শিক্ষকতায় বাঁধা পড়া জীবন

অবসরের পরও পাঠদান করান আবদুর রহমান। সম্প্রতি গুরুদাসপুরের খুবজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।  ছবি: প্রথম আলো
অবসরের পরও পাঠদান করান আবদুর রহমান। সম্প্রতি গুরুদাসপুরের খুবজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ছবি: প্রথম আলো

অবসরে গেছেন ১৪ বছর আগে। কিন্তু শিক্ষকতার মতো মহান পেশা ছাড়তে পারেননি আবদুর রহমান। এখন তাঁর বয়স ৭৯ বছর। তবু নিয়ম মেনে স্বেচ্ছাশ্রমে শিক্ষকতা করছেন তিনি। ভালোবেসে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়াতে পেশাটি ধরে রেখেছেন তিনি।

আবদুর রহমান নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার বামনবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা। তিনি ১৯৭২ সালে এসএসসি পাস করেন। ১৯৭৩ সালে বাড়ির পাশের বামনবাড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সেখানে চাকরি করেন তিনি। একই বছরের শেষের দিকে যোগদান করেন গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ২০০৫ সালে অবসরে যান তিনি।

কাগজে-কলমে অবসরে গেলেও শিক্ষকতা ছাড়েননি আবদুর রহমান। অবসরের সময় থেকেই এই পেশায় স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে চলেছেন তিনি। খুবজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্যারা শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। পঞ্চম শ্রেণিতে বাংলা, তৃতীয় শ্রেণিতে বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়, গণিত এবং চতুর্থ শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিষয়ে ক্লাস নিচ্ছেন তিনি। এ জন্য কোনো পারিশ্রমিক নেন না আবদুর রহমান।

বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক রীনা রানী সরকার বলেন, ‘প্রবীণ হলেও শারীরিক ও মানসিক শক্তি অনেক বেশি আবদুর রহমানের। সময় মেনে বিদ্যালয়ে আসেন; শিক্ষার্থীদের পড়ান অন্য শিক্ষকদের মতোই। পড়াতে গিয়ে কখনো তাঁকে ক্লান্ত হতে দেখিনি আমি।’ তিনি আরও বলেন, বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার পাঠ্যসূচি সম্পর্কে কোনো প্রশিক্ষণ নেই আবদুর রহমানের। তবু প্রশিক্ষিত শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করেন তিনি।

খুবজীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছেন রহিমা খাতুন ও তাঁর ছয় ভাই। তাঁদের সবার শিক্ষক ছিলেন আবদুর রহমান। এখন এই বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হয়েছেন রহিমা। আবদুর রহমানের শিক্ষকতার এই দুই সময়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখেন না তিনি। সহকারী শিক্ষক রহিমা খাতুন বলেন, ‘আবদুর রহমান আমাদের শিক্ষক ছিলেন। পড়ানো এবং অনুশাসনে আগের মতোই আন্তরিক তিনি। এখন তাঁর পরামর্শে বিদ্যালয়ে দায়িত্ব পালন করি। পাঠদানে অনুসরণ করি তাঁকে।’

বিদ্যালয়টির সাবেক সহকারী শিক্ষক সাহিদা খাতুন বর্তমানে খুবজীপুর ইউনিয়নের রুহাই সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তাঁর পেশাগত জীবনের ২২ বছরের সহকর্মী আবদুর রহমান। সাহিদার মতে, গণিত, বাংলা ও বিজ্ঞান বিষয়ে সমানভাবে পারদর্শী শিক্ষক আব্দুর রহমান।

স্থানীয় মেধাবিকাশ ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক ও খুবজীপুর ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মো. গোলাম মোস্তফা বলেন, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে আবদুর রহমান শিশুদের প্রতি ভালোবাসা থাকায় স্বেচ্ছাশ্রমে শিক্ষকতা করছেন। তাঁর কর্মদক্ষতায় শিক্ষার্থীরা উপকৃত হচ্ছে; খুশি অভিভাবকেরাও। রাষ্ট্রীয় বা সামাজিকভাবে কোনো সম্মাননা পাননি ত্যাগী এ শিক্ষক। তবে খুবজীপুর প্রাক্তন ছাত্র কল্যাণ সংগঠনের পক্ষ থেকে ২০১৭ সালে আবদুর রহমানকে সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।

শিক্ষকতা করতে গিয়ে কখনো নিজের প্রাপ্য ছুটি পুরোটা নিতে পারেননি আবদুর রহমান। এমনকি ছেলেমেয়েদের বিয়ের অনুষ্ঠানেও ছুটি ভোগ করেননি এ মানুষটি। সেটা এখনো মেনে চলেন তিনি। পরিমিত আহার ও বছরজুড়ে পান্তাভাত খেয়ে নিজের সুস্থতা রক্ষা করে চলছেন আবদুর রহমান। তাই বয়স আশির কোটা ছুঁতে চললেও পুরোদমে কাজ করতে পারেন। এখনো শিক্ষকতার বাইরে নিজের জমিজমা দেখাশোনা, ছেলেমেয়েদের খোঁজখবর রাখা, সাংসারিক কাজ এবং প্রতি শুক্রবার নিয়ম করে এলাকায় জমিজমা মাপজোকের কাজও করে থাকেন।

আবদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন শিশুদের পড়াতে গিয়ে আমি মায়ায় জড়িয়ে পড়েছি। তাই অবসরে যাওয়ার পরও স্কুলকে নিজের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারিনি। শিক্ষকতার পেশা ও নেশায় বাঁধা পড়েছি বলেই বিনা পারিশ্রমিকে পড়িয়ে যাচ্ছি। শরীরে যত দিন শক্তি-সামর্থ্য থাকে, তত দিন এই কাজ করে যাব।’