মায়ের প্রেরণায় বিশ্ববিদ্যালয়ে

মোহাম্মদ শাকিল খান
মোহাম্মদ শাকিল খান

কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে বাসা। দৃষ্টিহীন ছেলের ছায়াসঙ্গী হয়ে ছুটেছেন মা ফারজানা বেগম। চেষ্টার কমতি ছিল না ছেলেরও। অবশেষে সেই যৌথ প্রচেষ্টায় এল কাঙ্ক্ষিত ‘জয়’। নয় বছর আগে যাকে সবাই বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছিল, সেই মোহাম্মদ শাকিল খান এবার ভর্তি হয়েছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগে।

ছেলেকে নিয়ে মায়ের এই সংগ্রামের গল্প যেন শুধু গল্প নয়। এ যেন একটা ছায়াছবি। যে ছায়াছবির পরতে পরতে লুকিয়ে আছে—মা ও ছেলের ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা। সেখান থেকে সাফল্য।

এর আগে শাকিল চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষায় চট্টগ্রাম কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে জিপিএ-৫ নিয়ে পাস করেন। এসএসসি পরীক্ষায়ও ভালো ফল নিয়ে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। পেয়েছিলেন জিপিএ ৪.৪৫। এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় পা দিয়ে শাকিল যেন দেখিয়ে দিলেন—অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও মনের জোরকে সম্বল করে লক্ষ্যে অবিচল থাকলে যেকোনো বাধার পাহাড় ডিঙানো যায়।

ছেলেকে নিয়ে মা ফারজানা বেগমের সংগ্রাম শুরু হয় ২০১০ সালে। তখন গ্রামের বাড়ি সাতকানিয়ার বাজালিয়াতেই থাকত পুরো পরিবার। সে বছর নিজের হাতে লিখেই প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা দেন মোহাম্মদ শাকিল খান। এরপরেই সেই দুঃখের সঙ্গে পরিচয়। একটু একটু করে নিভে যেতে শুরু করে তাঁর চোখের আলো। দুচোখের নিত্য সঙ্গী হয়ে যায় ভারী চশমা।

এটি দেখে আশপাশের অনেকেই শাকিলকে বাতিলের খাতায় ফেলে দেন। বলতে থাকেন—তাঁকে দিয়ে আর পড়াশোনা হবে না। কিন্তু সেসবকে একেবারে পাত্তা দেননি শাকিলের মা এবং বাবা মো. আইয়ুব খান। মানুষের ‘যন্ত্রণা’ থেকে বাঁচতে গ্রাম ছেড়ে ছেলেকে নিয়ে মা ফারজানা বেগম চলে আসেন চট্টগ্রাম শহরে। ভর্তি করান নগরের মুরাদপুরের সরকারি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ে। সেই থেকে শুরু। ছেলেকে ঘুম থেকে তুলে পড়ার টেবিলে বসানো, খাবার খাইয়ে দেওয়া, তারপর তাঁকে নিয়ে স্কুলে দৌড়—ফারজানা বেগমের প্রতিদিনের এটাই যেন শিডিউল। এভাবে চলল কলেজ পর্যন্ত।

ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর কেমন অনুভূতি হচ্ছে—এমন প্রশ্নে ফারজানা বেগমের মুখে উপচে পড়ে হাসির ঝিলিক। বলেন, ‘ছেলে একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে—সেই স্বপ্ন দেখে আসছিলাম। আমার সেই স্বপ্নপূরণ হলো। আমার আর কিছুই চাওয়ার নেই। সে এবার নিজের স্বপ্নে বেড়ে উঠুক।’

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পরেও পা মাটিতেই রাখছেন শাকিল। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পড়াশোনা শেষে বিসিএস দিয়ে শিক্ষক হতে চাই। আর দাঁড়াতে চাই মানুষের পাশে।’

এর বাইরে মানুষের কাছে একটি ছোট্ট জিনিস চান শাকিল। সেটি হলো—কেউ যেন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ডেকে তাঁদের হেয় না করেন। কারণ, তাঁরা যে ভিন্নভাবে সক্ষম। সেই চোখেই তাঁদের যেন দেখা হয়।