মানবাধিকার পরিস্থিতি আগের মতোই নাজুক

গুম-খুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও নিখোঁজ স্বজনদের ফিরে পেতে ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের আয়োজনে মানববন্ধন। ২০১৯ সালের মে মাসে।  ফাইল ছবি
গুম-খুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও নিখোঁজ স্বজনদের ফিরে পেতে ‘মায়ের ডাক’ সংগঠনের আয়োজনে মানববন্ধন। ২০১৯ সালের মে মাসে। ফাইল ছবি

‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুমসহ নানা কারণে দেশের মানবা​ধিকার পরিস্থিতি অনেক বছর ধরেই নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এসবের অবসান ঘটিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। টানা তৃতীয়বার ক্ষমতায়​ আসার পর মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এমনটা বলেছিলেন। এরপর গত এক বছরে পরিস্থিতির কতটা উন্নতি হলো? বছর শেষের পরিসংখ্যান বলছে, পরিস্থিতি সেই আগের মতোই নাজুক রয়ে গেছে।

বেসরকা​রি মানবা​ধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে, চলতি বছর প্রতিদিন গড়ে একজন ব্যক্তি ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যুর শিকার হয়েছেন। চলতি বছর নতুন করে গুমের তালিকায় যুক্ত হয়েছেন আরও আটজন। যৌন হয়রানি ও সহিংসতা এবং ধর্ষণের শিকার নারীর সংখ্যাও অনেক। নারী নির্যাতনকারী হিসেবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নামও এসেছে। এ ছাড়া সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, মতপ্রকাশে বাধার অভিযোগ ছিল বছরজুড়ে, অব্যাহত ছিল সীমান্ত হত্যা।

এর মধ্যে ব্যতিক্রমী ঘটনা ছিল জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের নেতৃত্বে সরকারি দলের হাজির হওয়া ও প্রতিবেদন পেশ করা। কুড়ি বছর আগে জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছিল ঠিকই, কখনো কোনো অধিবেশনে উপস্থিত হয়নি, প্রতিবেদন তো দূরের কথা।

যদিও স্বাক্ষরকারী রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নিষ্ঠুর, অমানবিক, অবমাননাকর ব্যবহার ও শাস্তি প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং নিয়মিত কমিটির কাছে অগ্রগতি প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ বছর কমিটিতে উপস্থিত হয়ে সরকারি প্রতিনিধিদল সংবিধান কীভাবে মানুষকে সুরক্ষা দিয়েছে এবং মানবাধিকার রক্ষায় কী কী আইন করেছে, সে সম্পর্কে জানিয়েছে। তবে ২০১৪ সালে নারায়ণগঞ্জে র‍্যাবের হাতের সাত খুনের ঘটনা ছাড়া বাকি সব বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। যদিও ওই কমিটিকে দেওয়া বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বয়ান ছিল আলাদা। তারা মোটাদাগে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে মৃত্যু, মতপ্রকাশে বাধাসহ কিছু বিষয়ের ওপর পর্যবেক্ষণ দেয়।

এই বিষয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটিতে আমাদের উপস্থিতিই প্রমাণ করে, মানবাধিকার বিষয়টি আমরা কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ যাঁরা করছেন, তাঁরা দেশবিরোধী প্রচার চালাতে চান।’ তিনি দাবি করেন, দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীরা যখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখোমুখি হয়, তখন কিছু এনকাউন্টার বা বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। গুম করে কাউকে অজ্ঞাত স্থানে রাখা হয় না। দু-একটি ঘটনা ঘটে থাকতে পারে, এতে যাদের যুক্ততার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

>

মানবাধিকার ২০১৯: ফিরে দেখা। চলতি বছর প্রতিদিন গড়ে একজন ‘বন্দুকযুদ্ধের’ নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও হেফাজতে মৃত্যুর শিকার হয়েছেন।

তবে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, ১৯৯৮ সালে ডিবি হেফাজতে বিশ্ববিদ্যালয়ছাত্র রুবেল খুন হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি বেশ কিছু নির্দেশনা ​দিয়েছিলেন। যার আলোকে হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতন (নিবারণ) আইনও পাস করে সংসদ। তারপরও হেফাজতে মৃত্যু ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। চলতি বছর ঢাকার উত্তরা ও কেরানীগঞ্জে একজনকে পিটিয়ে হত্যা এবং আরেকজনকে পায়ে গুলি করে আহত করার অভিযোগ আছে পুলিশের বিরুদ্ধে।

গুম, খুন, হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ

আসকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও হেফাজতে মৃত্যুর শিকার হয়েছেন ৩৬২ জন। এঁদের মধ্যে ১৭৯ জনই নিহত হয়েছেন পুলিশের গুলিতে বা জিম্মায় থাকাকালীন। এর বাইরে ৯৭ জন র‍্যাবের, ৩১ জন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি), ৫৩ জন বিজিবির সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন।

রাজনৈতিক নেতা, মাদ্রাসাশিক্ষক, সাবেক সেনাসদস্যসহ এ বছর গুম হয়েছেন ১৩ জন। গুম হওয়ার পর ফিরে এসেছেন চারজন, পরে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে একজনকে। বাকি আটজন কোথায়, কেমন আছেন কেউ জানেন না। ফিরে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে সবশেষ ব্যক্তি সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান। গুম হওয়ার ৪৬৭ দিন পর তিনি এ বছরের ১৬ মার্চ ফিরে আসেন। মারুফ জামান বা তাঁর আগে যাঁরা ফিরে এসেছেন, তাঁরা কেউ আজ পর্যন্ত মুখ খোলেননি।

আসকসহ দেশি–বিদে​শি মানবা​ধিকার সংগঠনগুলোর হিসাবে, এক দশকে দেশে গুমের সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়েছে। মা, স্ত্রী, সন্তানসহ স্বজনেরা প্রিয়জনকে ফিরে পেতে প্রতিবছর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে জড়ো হন। সন্তানদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানান, কাকুতি–মিনতি করেন। কিন্তু তাঁদের অপেক্ষার প্রহর শেষ হয় না।

মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে পিছিয়েছে বাংলাদেশ

প্যারিসভিত্তিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স (আরএসএফ) গত এপ্রিলে সর্বশেষ বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচক প্রকাশ করেছে। তাতে আগের বছরের তুলনায় চার ধাপ পিছিয়ে বাংলাদেশ। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা সরকারের কঠোর অবস্থানের শিকার হচ্ছেন। আসকের হিসাবে এ বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত দেশে ১৩৪ জন সাংবাদিক নির্যাতন, হুমকি, হয়রানি ও হামলার শিকার হয়েছেন।

বছরের প্রথম দিনেই নির্বাচনের ত্রুটিপূর্ণ ফল ঘোষণার অভিযোগে খুলনায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা করেন উপজেলা প্রশাসন। এক সাংবাদিককে গ্রেপ্তারও করা হয়।

নারী, শিশু নির্যাতনে ক্ষমতাসীন দল ও পুলিশ

গত বছরের ৩০ ডিসেম্বর পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ায় ধর্ষণের শিকার হন সুবর্ণচরের এক নারী। ক্ষমতাসীন দলের লোকজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে গণধর্ষণের। এরপর এপ্রিলে সুবর্ণচরেই আরেক নারী ধর্ষণের অভিযোগ করেন। বছরজুড়ে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা অব্যাহত ছিল।

পুলিশ সদর দপ্তরনারীর প্রতি সহিংসতার পরিসংখ্যান দিতে পারেনি। প্রথম আলোকে মাত্র তিন মাসের তথ্য দিতে সমর্থ হয়েছে। এ বছরের প্রথম তিন মাসে ধর্ষণের অভিযোগে সারা দেশে মামলা হয়েছে ২ হাজার ৩২১টি। এগুলোর মধ্যে পুলিশ তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র দিয়েছে ৮১৩টি মামলায়, আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে ১৪৮টিতে।

মানবাধিকার কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

এ পরিস্থিতিতে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের অবস্থান ছিল নড়বড়ে। মানবাধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রীয় এই কমিশনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন অনেক। গত ২৮ নভেম্বর জাতীয় মানবাধিকার কমিশন বিষয়ে আসক আয়োজিত এক সংলাপে বলা হয়, কমিশনের চেয়ার ও সদস্য নিয়োগপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ নয়। কমিশন গঠনে আমলাতন্ত্রের প্রভাব রয়েছে। বর্তমান চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিব, আর সার্বক্ষণিক সদস্য সাবেক স্বরাষ্ট্রসচিব কামাল উদ্দীন।

এ বিষয়ে চেয়ারম্যানের বক্তব্য জানা যায়নি। তিনি ছেলের অসুস্থতার কারণে কথা বলতে অপারগতা জানান।

বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর ভূমিকাও যে খুব জোরালো ছিল, তা বলা যাবে না। জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সাড়ে তিন শর বেশি মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেও মানবা​ধিকার সংগঠনগুলো সভা-সেমিনার ও বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব সেরেছে।

তবে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগর অধ্যাপক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের কথা কেউ প্রকাশ করলেই তাঁকে রাষ্ট্রবিরোধী তকমা দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে সত্য, কিন্তু মানুষের রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার ক্রমশ সংকুচিত হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে একজন মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হচ্ছেন, এটা খুব উদ্বেগের কথা। কিন্তু এই উদ্বেগ কি যথাস্থানে পৌঁছাচ্ছে?