বছরজুড়ে আলোচনায় যৌন নির্যাতন

নোয়াখালীতে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া নুসরাত জাহানকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে আনা হয়। বার্ন ইউনিটের লিফটে নেওয়ার আগে।  ফাইল ছবি
নোয়াখালীতে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া নুসরাত জাহানকে গুরুতর আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেলে আনা হয়। বার্ন ইউনিটের লিফটে নেওয়ার আগে। ফাইল ছবি

বিদায়ী বছরে নারীর প্রতি সহিংসতার পারদ ছিল ঊর্ধ্বমুখী। প্রতিদিনের পত্রিকা বলছে, যৌন সহিংসতা-নিপীড়ন বেড়েছে প্রকটভাবে। বিশেষত পথেঘাটে, গণপরিবহনে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা অনলাইনে, আর অবশ্যই ঘরে-পাড়ায়। পারিবারিক নির্যাতনও কমেনি। তবে দু-একটি ঘটনার প্রতিবাদ ও বিচারপ্রক্রিয়া বছরটিকে আলাদা করেছে।

গত অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ঘটেছে অন্তত হাজার দেড়েক, মাসে গড়ে আগের বছরের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি হারে। যৌন হয়রানির ক্ষেত্রেও প্রবণতা এমনই। ধর্ষণসহ যৌন সহিংসতায় এবং পারিবারিক ও যৌতুকের জন্য নির্যাতনে খুন হয়েছে অন্তত চার শর মতো নানা বয়সী নারী।

নির্যাতনকারীদের মধ্যে আলোচিত হয়েছে মাদ্রাসাশিক্ষক ও পুলিশের নাম। স্বামীর হাতে নির্যাতনের ঘটনা বরাবরের মতোই বেশি। বেড়েছে ইন্টারনেট প্রযুক্তি দিয়ে হেনস্তা করার সাইবার অপরাধ।

তবে যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুশয্যায় ফেনীর তরুণী নুসরাত অপরাধীদের শাস্তি চেয়েছেন। দ্রুত বিচার হয়েছে। আরও কিছু আলোচিত ঘটনায় তদন্ত ও ব্যবস্থা নেওয়ার নজির আছে।

নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা বুঝতে প্রথম আলো যৌন হয়রানি ও সহিংসতা, ধর্ষণ, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, অন্য পারিবারিক নির্যাতন এবং গৃহকর্মী নির্যাতনের হিসাব দেখেছে। পরিসংখ্যানগুলো নেওয়া হয়েছে মূলত মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) মাসওয়ারি প্রতিবেদন থেকে। ৯টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকার সংবাদ ও নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে আসক প্রতিবেদনগুলো করে। হিসাব পাওয়া গেছে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত।

প্রথম আলো আরও দেখেছে নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে সরকারের মাল্টিসেক্টরাল কর্মসূচির আওতায় পরিচালিত ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) ও সেলে সেবাগ্রহীতাদের হিসাব। দেখা হয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ বিভাগে জমা পড়া অভিযোগের হিসাব। এই দুটি কর্তৃপক্ষের গত বছরের হিসাব পাওয়া গেছে নভেম্বর মাস পর্যন্ত। এসব হিসাবও ২০১৯ সালে নির্যাতন বাড়ার কথা বলছে।

মাল্টিসেক্টরাল কর্মসূচির পরিচালক আবুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নারী নির্যাতনের ঘটনার সংখ্যা বাড়াটা উদ্বেগের। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে এখন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেও অভিযোগ আসছে, মানুষের মধ্যে বিচার চাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।

>

নারীর প্রতি সহিংসতা ২০১৯: ফিরে দেখা। যৌন সহিংসতা অনেক বেড়েছে। ধর্ষণের শিকার মূলত শিশু–কিশোরী। হত্যা বেশি পারিবারিক নির্যাতনে, স্বামীর হাতে।

আবুল হোসেন আরও বলেন, ২০১৫ সালের পর নারীর প্রতি সহিংসতা নিয়ে কোনো জরিপ হয়নি। নির্যাতন নিরসনে করণীয় ঠিক করতে নিয়মিত জরিপ জরুরি। তাতে নির্যাতন ও নির্যাতনকারীদের ধরন বোঝা যাবে। পাশাপাশি প্রবণতা বিচার করে অঞ্চলভিত্তিক উদ্যোগ নেওয়াও জরুরি।

যৌন সহিংসতা দ্বিগুণেরও বেশি

আসকের হিসাবে বিদায়ী বছরের প্রথম ১০ মাসে ১ হাজার ২০০–এর মতো ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। প্রকাশিত এসব ঘটনার প্রায় এক-চতুর্থাংশ ছিল গণধর্ষণ। ধর্ষণচেষ্টার ঘটনা ঘটেছে আরও ২০০টি। অর্থাৎ গড়ে মাসে ঘটনা দাঁড়ায় ১৪৫টি। গত বছর এই মাসিক হার ছিল ৭০টি। আর গত পাঁচ বছর ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার বছরওয়ারি সংখ্যা ছিল হাজারের নিচে।

বিদায়ী বছরে প্রায় অর্ধেক ঘটনায় ভুক্তভোগীর বয়স দেওয়া আছে। তাদের অর্ধেকের বেশি ১২ বছর বা তার কম বয়সী। এই বয়সী ভুক্তভোগী বেড়েছে। আদতে ৮৫ শতাংশেরই বয়স ১৮ বছরের নিচে। দেখা যায়, ছয় বছরের কম বয়সী ১২৮টি শিশু ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছে। গত পাঁচ বছরের প্রতিবছর এই বয়সী ভুক্তভোগী অনেক কম ছিল।

গত ২৫ জুলাই রাজধানীর ওয়ারীতে নিজের বাড়ির ছাদে সাত বছরের শিশু সামিয়া আক্তারকে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। অভিযুক্ত প্রতিবেশী হারুন অর রশীদ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আদালতকে বলেছেন, ধর্ষণের পর ধরা পড়ার ভয়ে শিশুটিকে হত্যা করেছেন।

ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টার শিকার নারী-শিশুদের মোট ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ আত্মহত্যা করেছে। বাকিরা হত্যার শিকার। অর্ধেকের কিছু বেশি ভুক্তভোগীর বয়স পাওয়া যায়। ৭০ শতাংশের বয়স ১৮ বছরের নিচে। প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ১২ বছর বা তার কম বয়সী। গত বছরের চেয়ে আত্মহত্যা বেড়েছে।

এ ছাড়া অক্টোবর মাস পর্যন্ত ২৪৭টি যৌন হয়রানি ও সহিংসতার ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। গড়ে মাসে দাঁড়ায় ২৫টি ঘটনা, গত বছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। যৌন হয়রানির জেরে আত্মহত্যার সংখ্যাও বেড়েছে। তবে হত্যার সংখ্যা বাড়েনি। দুই ক্ষেত্রেই সংখ্যাটি ১২।

হবিগঞ্জের চুনারুঘাটে হোসনা খাতুনকে (২৬) প্রায়ই উত্ত্যক্ত করত প্রতিবেশী কলেজছাত্র সাইফুর রহমান। স্বামী প্রবাসী, হোসনা নিজেই প্রতিবাদ করেছিলেন। গত ১ জুলাই সাইফুর তাঁর ঘরে ঢুকে ছুরি মারলে হোসনা মারা যান। তবে সাধারণভাবে খুন বেশি হয়েছে প্রতিবাদী পুরুষ, আর আত্মহত্যা করেছে শুধুই মেয়েরা। প্রতিবাদ করে লাঞ্ছিত হয়েছেন অনেক নারী।

বিদায়ী বছরে নারীর প্রতি সহিংসতার বড় ঘটনা বলতে সবচেয়ে বেশি চোখে ভাসে শিশু-কিশোরী ধর্ষণ এবং ধর্ষণ ও হত্যার কয়েকটি ঘটনা। এই তালিকায় ঢুকে পড়ে রাজধানীর উত্তর বাড্ডা এলাকায় ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত তাসলিমা বেগমের নাম। ২০ জুলাইয়ের ওই ঘটনা নৃশংসতার বড় নজির হিসেবে মানুষের বহুকাল মনে থাকবে।

হত্যা সহিংসতার চরম একটি রূপ। বরাবরের মতো বিদায়ী বছরেও হত্যার ঘটনাগুলো সবচেয়ে বেশি ঘটেছে ঘরের চার দেয়ালের মধ্যে, পরিবারের সহিংসতায়। আসকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অক্টোবর পর্যন্ত এমন হত্যার সংখ্যা ছিল ৩২৫। প্রায় সবগুলো হয়েছে বিশেষত স্বামীর হাতে পারিবারিক নির্যাতনে এবং যৌতুকের কারণে।

পরিবার ও হত্যা

আসকের প্রতিবেদনে পারিবারিক নির্যাতনের মধ্যে আছে স্বামী, স্বামীর পরিবার ও নিজ পরিবারের হাতে মারধর ও হত্যা এবং আত্মহত্যার ঘটনা। যৌতুকের জন্য মারধর, তাড়িয়ে দেওয়া, আত্মহত্যা ও হত্যার ঘটনাগুলো আলাদা গোনা হয়েছে। বিদায়ী বছরে মোট ৩৩৭টি পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনার হিসাব আছে, গড়ে মাসে ৩৪টি। গত বছরও চিত্রটি একই রকম ছিল।

পত্রিকায় প্রকাশিত এসব ঘটনার প্রায় তিন-চতুর্থাংশই হত্যার, বড় অংশ স্বামীর হাতে। গত বছরের চেয়ে স্বামীর হাতে মৃত্যুর হার কিছুটা বেড়েছে। স্বামীর পরিবার আর নিজের পরিবারের হাতে হত্যার ঘটনা প্রায় সমান।

বিদায়ী বছরে পারিবারিক নির্যাতনের জেরে মাসে গড়ে প্রায় পাঁচটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। গত বছর এই হার সামান্য কম ছিল। যৌন নির্যাতন–নিপীড়নের ক্ষেত্রে মূলত শিশু-কিশোরীদের শিকার হতে দেখা গেছে। পারিবারিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে অন্তত ৯০ শতাংশ ভুক্তভোগীর বয়স ১৯ থেকে ৩০-এর মধ্যে বা তার বেশি।

 অক্টোবর পর্যন্ত আসক যৌতুকের কারণে নির্যাতনের ১৩৫টি ঘটনার কথা জেনেছে। এগুলোর ৭৮টি অর্থাৎ প্রায় ৬০ ভাগই হত্যার ঘটনা। গতবার কিন্তু হত্যার হার এর বেশ কম ছিল। ভুক্তভোগীদের অন্তত অর্ধেকের বয়স ১৯ থেকে ২৪-এর মধ্যে।

গত ১২ মার্চ রাতে নারায়ণগঞ্জ সদরে স্বামীর বাড়িতে খাটের নিচে খাদিজা আক্তার (২১) নামের এক নারীর লাশ পাওয়া যায়। তাঁর পরিবারের অভিযোগ, মেয়েকে মেরেছেন তাঁর স্বামী মো. ফরহাদ। বিয়ে হয়েছিল চার বছর। যৌতুকের জন্য নির্যাতন চলেছে শুরু থেকে। মেয়ে আগের দিনই ফতুল্লা থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছিলেন।

ঘরে সহিংসতার আরেক চিত্র গৃহকর্মী নির্যাতন। আসকের হিসাবে, বিদায়ী বছরে প্রকাশিত ঘটনার মাসিক গড় কমে ৩২-এ নেমেছে। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ হচ্ছে ধর্ষণের ঘটনা। ছিল একটি হত্যা আর একটি আত্মহত্যা। অনেকটা কমেছে সালিস-ফতোয়া আর অ্যাসিড–সন্ত্রাসের ঘটনাও।

বেড়েছে সাইবার নির্যাতন

গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় তোলা ঘটনাগুলোর ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া ত্বরান্বিত হতে দেখা যায়। আবার ফেসবুককে কেন্দ্র করেই বাড়ছে সাইবার অপরাধের হার।

ডিএমপির সাইবার নিরাপত্তা ও অপরাধ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার সায়েদ নাসিরুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, এমন অপরাধের প্রধান ভুক্তভোগী তরুণ নারীরা। অভিযুক্তরাও তরুণ। অভিযোগ আসে মূলত ফেসবুক হ্যাক করে ব্ল্যাকমেল করা এবং বাজে লেখা-ছবি পাঠানোর। বিদায়ী বছরে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত এমন অভিযোগ এসেছে আড়াই হাজারের বেশি, যা গত বছরের অভিযোগের দ্বিগুণের কাছাকাছি।

প্রতিবাদের ফুলকি, সামনের পথ

ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা তাঁর অফিসকক্ষে ডেকে মেয়ের শ্লীলতাহানি করেছেন—এই অভিযোগে মামলা করেছিলেন আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহানের মা। এরই জেরে ৬ এপ্রিল অধ্যক্ষের নির্দেশে পাঁচজন নুসরাতের হাত-পা বেঁধে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেন।

চার দিন পর নুসরাত মারা যান। হাসপাতালের বিছানা থেকে নুসরাত বিচার চেয়ে গেছেন। ঘটনাটি সংবাদমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বিচার দ্রুত হয়। ২৪ অক্টোবর জেলার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল অভিযুক্ত সাবেক অধ্যক্ষসহ ১৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

২০১৮ সাল শেষ হয়েছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ৩০ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে নোয়াখালীর সুবর্ণচরে এক নারীর গণধর্ষণের ঘটনা দিয়ে। তিনি স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কথা অগ্রাহ্য করে ভিন্নমতের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছিলেন। তাঁর স্বামী মামলায় অভিযোগ করেছেন, এই কারণেই তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ২০১৯ সালে মামলাটির বিচার শুরু হয়। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই ঘটনাটিও খবরে-ফেসবুকে শোরগোল জাগিয়েছিল।

তবে আসকের নির্বাহী পরিচালক শীপা হাফিজার মতে, নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাগুলোর বড়জোর ২–৩ শতাংশ খবরে উঠে আসে। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, এই খণ্ডচিত্রই যথেষ্ট উদ্বেগজনক। ধর্ষণের ব্যাপ্তির ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি। দিনবদলের জন্য আইন, স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে কার্যকর ও সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ নিতে হবে।