শরীয়তপুর সদরে রমিজ বাহিনীর 'তাণ্ডব', এযাবৎ ৫০ মামলা

শরীয়তপুর সদর উপজেলার চিকন্দি ইউনিয়নের আবুরা গ্রামের বাসিন্দা রমিজ খাঁ চোখে দেখেন না। স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, তাঁর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ হয়ে ১৯৮৫ সালে লোকজন তাঁকে মারধর করে। তখন চোখে আঘাত পেয়ে তিনি দৃষ্টিশক্তি হারান।

কিন্তু কমেনি রমিজ খাঁর (৭১) সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। নিজের ৯ ছেলে ও আত্মীয়স্বজন দিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘রমিজ বাহিনী’। তাঁর নির্দেশনাতেই এখন বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালান। তাঁর ছেলে মোদাচ্ছের খাঁ বর্তমানে বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। ওই বাহিনীর তাণ্ডবে সদর উপজেলার চিকন্দি, ডোমসার, শৌলপাড়া ও বিনোদপুর ইউনিয়নের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। রমিজ খাঁ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপরাধে ৫০টি মামলা রয়েছে।

শরীয়তপুরের পুলিশ সুপার আব্দুল মোমেন বলেন, ‘রমিজ বাহিনী নামে কোনো বাহিনী রয়েছে, এমন কোনো বিষয় আমার জানা ছিল না। সম্প্রতি একটি ছিনতাইয়ের মামলার সূত্র ধরে কিছু ঘটনার খবর সামনে আসছে। শরীয়তপুরে কোনো বাহিনী থাকবে না। অপরাধ যিনি করবেন, তাঁকেই আইনের আওতায় আনা হবে।’

থানা-পুলিশ সূত্র জানায়, গত ২৯ নভেম্বর চিকন্দি বাজারের ব্যবসায়ী শাহজাহান মাদবর, তাঁর ছেলে জোনায়েত মাদবর ও ভাতিজা মিজান মাদবরকে মারধর করে পাঁচ লাখ টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠে রমিজ বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে। একটি মামলা দায়ের করা হয় এ বাহিনীর ৯ সদস্যর বিরুদ্ধে। পুলিশ এ ঘটনায় যুক্ত থাকার অভিযোগে রমিজ খাঁর ছেলে আজিজুল খাঁ ও অহেদ খাঁকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছেন।

স্থানীয় ব্যক্তিরা বলেন, রমিজ খাঁর ভয়ে কোনো ব্যক্তি থানায় অভিযোগ দিতে সাহস পেত না। এলাকার রাজনৈতিক নেতারা বিভিন্ন সময় তাঁদের প্রশ্রয় দিতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে তাঁর দুই ছেলে গ্রেপ্তার হওয়ার পর ওই বাহিনীর হাতে বিভিন্ন সময় নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিরা এখন বিচারের দাবিতে মুখ খুলতে শুরু করছেন। পাঁচ ব্যক্তি সম্প্রতি থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

সদরের পালং মডেল থানা সূত্র জানায়, দুই লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর চিকন্দির আবুরা গ্রামের মোতালেব মাদবরকে পিটিয়ে পা ও পাঁজর ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে রমিজ বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে। তিনি মামলা করার উদ্যোগ নিলে তাঁর সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলেকে তুলে নিয়ে যায় রমিজ বাহিনীর সদস্যরা। মামলা করা হবে না এমন মুচলেকা দিয়ে ছেলেকে ছাড়িয়ে আনা হয়। ওই ঘটনার পর তাঁকে এলাকা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রায় এক বছর পর এক পা–হারা মোতালেব ১৬ ডিসেম্বর পালং মডেল থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।

মোতালেব মাদবর বলেন, এলাকার কৃষক, ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী মানুষের প্রত্যেককে রমিজ বাহিনীর সদস্যদের চাঁদা দিতে হয়। কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালেই নির্যাতন চালানো হয়।

২০১৮ সালের ডিসেম্বরে চাঁদার দাবিতে চিকন্দি বাজারের ব্যবসায়ী রুবেল তালুকদারকে কুপিয়ে আহত করা হয়। তাঁর পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়। দোকান ভাঙচুর করে বাজার থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। রুবেল পালিয়ে ঢাকায় আশ্রয় নেয়। সম্প্রতি ওই বাহিনীর দুই সদস্য গ্রেপ্তার হলে এবং অন্যরা পালালে তিনি গ্রামে ফিরে আসেন।

 চিকন্দি ইউনিয়ন পরিষদের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য তমিজ খাঁ বলেন, রমিজ খাঁ তাঁর আপন বড় ভাই। পাঁচ বছর আগে সহায়–সম্পদ দখল করে তাঁকে (তমিজ) বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। এখনো তিনি সম্পদ ফেরত পাননি। ভয়ে পৈতৃক বাড়িতে ফিরতে পারছেন না।

থানা-পুলিশ সূত্র জানায়, রমিজ খাঁ আর তাঁর বাহিনীর বিরুদ্ধে জমি দখল, চাঁদা আদায়, মারপিট, হত্যার চেষ্টাসহ বিভিন্ন অপরাধে গত ২০ বছরে ৫০টি মামলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ১১টি মামলায় অভিযুক্তরা বিভিন্ন সময় খালাস পেয়েছেন। মামলাগুলোর মধ্যে রমিজ খাঁ ১২টির আসামি।

এত অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে রমিজ খাঁ বলেন, তাঁর ৯ ছেলে। তাঁরা বড় হয়েছেন, সবাই নিজেদের মতো কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এলাকায় কিছু মানুষের সঙ্গে জমিজমা নিয়ে তাঁদের বিরোধ রয়েছে। ওই সব কারণে কিছু মামলা হয়েছে। তারাই তাঁদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে।

পালং মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. আসলাম উদ্দিন বলেন, রমিজ বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে ৫০টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে। ওই মামলাগুলোতে তাঁরা জামিনে রয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি আরও পাঁচটি অভিযোগ পাওয়া গেছে। ওই অভিযোগগুলো তদন্ত করা হচ্ছে।